মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আ.লীগ ‘আউট’ বিএনপি ‘ইন’

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:৪৩ এএম, ৩ নভেম্বর ২০২৪ রোববার

অবৈধ গ্যাস সংযোগ

  •     উপজেলা জুড়ে ৩০ হাজার অবৈধ সংযোগ
  •     ৬০-৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে গ্রাহকদের
  •     ঘটছে বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা
  •     অবৈধদের কারণে ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছেন না বৈধ গ্রাহকরা
  •     আ.লীগ সরকারের পতনের পর নিয়ন্ত্রণে বিএনপি নেতারা

 


উৎপাদন ও সরবরাহ সংকটের কারণে নতুন করে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে সরকার। গ্যাসসংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্প-কারখানায়। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা গেছে রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। সেখানে যেন চলছে অবৈধ গ্যাসসংযোগ দেওয়ার মহোৎসব। প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দার এ উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে এক হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা। পুরো উপজেলায় তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানির সরবরাহ লাইন থেকে টানা ৩৫ হাজারের বেশি আবাসিক সংযোগ রয়েছে, যার ৯৫ শতাংশ সংযোগই অবৈধ। নিম্নমানের পাইপ ও সামগ্রী ব্যবহার করে নেওয়া হয়েছে এসব সংযোগ।

জরাজীর্ণ লোহার পাইপ, এমনকি মাটির ওপর দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমেও দেওয়া হয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। যে কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আর এসব অবৈধ সংযোগ পেতে প্রতি সংযোগে ৬০-৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে গ্রাহকদের। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও দালাল চক্রের সদস্যদের দিতে হয়েছে ওই টাকা। এ ছাড়া অভিযানে কোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ২০-৩০ হাজার টাকা নিয়ে ফের সেই সংযোগ সচল করে দালাল চক্র। এদিকে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর টাকা নিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে বারবার হামলার শিকার হয়েছেন তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যে কারণে এখন অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযানে যেতে তাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তিতাসের অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে প্রায় শতকোটি টাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, দালাল চক্র ও তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে ঢুকেছে। এসব অবৈধ সংযোগের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে প্রায় দুই হাজার। তিতাসের কয়েকজন কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের মাসোহারার মাধ্যমে ম্যানেজ করে দুইশোর বেশি কারখানা ও বেকারিতে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব সংযোগ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা মাসোয়ারা তোলে দালাল চক্র ও তিতাসের কয়েকজন কর্মচারী। এসব অবৈধ আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার গ্যাস ব্যবহার হয়। এতে সরকার বছরে যেমন কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধ সংযোগ থেকে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত ২৫ অক্টোবর রাতে এমনই এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ডহরগাঁও এলাকায় বিস্ফোরণে ছয়জন দগ্ধ হয়েছেন। এরই মধ্যে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা দেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধের পর বাড়ে অবৈধ সংযোগ নেওয়ার তোড়জোড়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মী, তিতাস গ্যাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি চক্র। যে চক্র প্রতিটি আবাসিক অবৈধ গ্যাস সংযোগের জন্য নিয়েছে ৬০-৮০ হাজার টাকা করে। উপজেলার তারাব, বিশ্বরোড, মৈকুলী, খাদুন, কাহিনী, মুড়াপাড়া, বানিয়াদী, হাটাবো, কালি, আমলাবো, কাঞ্চন, নলপাথর, গোলাকান্দাইল, হোড়গাঁও , ডরগাঁও, সাওঘাট, ভুলতা, গন্ধর্বপুর, রূপসী, নতুন বাজার, বরপা, আড়িয়াবো, সুতালারা, পাড়াগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতে রাস্তা কেটে উচ্চচাপের সরবরাহ লাইন ছিদ্র করে ১, ২ বা ৩ ইঞ্চি ব্যাসের নিম্নমানের লোহার বা প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে নেওয়া হয়েছে এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ। নিম্নমানের পাইপের কারণে খুব অল্পদিনেই এসব সংযোগে তৈরি হয়েছে লিকেজ। সহজলভ্য হওয়ায় নতুন বাড়িঘর এবং বহুতল ভবনগুলোতেও নেওয়া হয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। তবে এসব সংযোগের জন্য কোনো ধরনের মাসিক বিল দিতে হয় না গ্রাহককে।

নেতৃত্বে আ.লীগ নেতাকর্মীরা : উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নে প্রায় পাঁচ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে এই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদ আলীর নেতৃত্বে। হাটাবো এলাকায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল এবং যুবলীগ নেতা আলম হোসেন ও আরিফের নেতৃত্বে পাঁচশোর বেশি অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে উপজেলা যুবলীগ সভাপতি কামরুল হাসান তুহিন, গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি শফিকুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা কাজল ও নূর আলম এবং তিতাস অফিসের দালাল রাজীবের নেতৃত্বে পুরো ইউনিয়নের পাঁচ হাজারের বেশি অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ভুলতা ইউনিয়নে যুবলীগ নেতা শাহ-আলম এবং কাঞ্চন পৌর এলাকায় পৌর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসূল কলির নেতৃত্বে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গোলাম রসূল কলি সংযোগ বৈধ করে দেওয়ার কথা বলে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে নেন। সেই টাকা এখন পর্যন্ত ফেরত পাননি গ্রাহকরা। তারাব পৌরসভার বরপা এলাকায় সাবেক কাউন্সিলর আশরাফুল ও যুবলীগ নেতা বায়জিদ সাউদের নেতৃত্বে টাকা নিয়ে প্রায় তিন হাজার অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুড়াপাড়া, রূপসী, মৈকুলী, বিশ্বরোড ও তারাব এলাকায় আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা টাকার বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেন।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ গ্রহীতাদের মধ্যে একজন গোলাকান্দাইল এলাকার সুমন চন্দ্র। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বাসায় গ্যাস সংযোগের জন্য দালাল চক্রকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। তারা বাড়ির দলিল, পর্চা ও ছবিও জমা নিয়েছে। বলেছিল দ্রুত সংযোগটি বৈধ করে দেবে। কিন্তু আর বৈধ করে দেয়নি, তাই অবৈধভাবেই গ্যাস ব্যবহার করছি।’

অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, তারা ধারদেনা করে এবং গরু-বাছুর, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করে গ্যাস সংযোগের জন্য টাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও দালাল চক্রকে। দালাল চক্র এসব সংযোগ বৈধ করে দেবে বলে বুঝিয়েছিল। এখন টাকা দিয়ে বিপাকে পড়েছেন অবৈধ সংযোগ নেওয়া ব্যক্তিরা।

ঘটছে প্রায় দুর্ঘটনা : অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে গত কয়েক বছরে এক ডজনের বেশি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ২৭ এপ্রিল রূপসী এলাকায় রূপসী-কাঞ্চন সড়কে হাইপ্রেশার পাইপলাইন থেকে অবৈধ সংযোগ নেওয়া সার্ভিস লাইনে বিস্ফোরণ হয়। এতে প্রায় ১২ ঘণ্টা ওই এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সাওঘাট এলাকায় হাইপ্রেশার পাইপলাইন থেকে একটি পাকা বাড়িতে অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়ার সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই শামীম ও হেলাল বিশ্বাস নামে দুজন নিহত হন। আহত হন আরও ছয়জন। বিস্ফোরণে ওই বাড়ির দেয়াল উড়ে যায়। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বানিয়াদী এলাকায় অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া দুটি রাইজার থেকে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়।

অভিযানে বাধা-হামলা ও ফের সংযোগ : ২০২২ সালের ১৪ মার্চ কাঞ্চন এলাকায় অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে হামলার শিকার হন তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ সময় তাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান তিতাসের লোকজন। গত বছরের ৩ জানুয়ারি গোলাকান্দাইল ও বাঘমুড়া হিজলগাছ পর্যন্ত ৬ শতাধিক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তিতাস কর্র্তৃপক্ষ। পরে দালাল চক্র ফের সংযোগ দিয়ে দেয়। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর মৈকুলী ও বরপা এলাকায় প্রায় দুই হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পরে দালাল চক্র ফের সেসব সংযোগ দিয়ে দেয়। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ২০২১ সালের ২৮ মে যাত্রামুড়া তিতাস গ্যাস অফিসে হামলা করে অবৈধ সংযোগ নেওয়া লোকজন। কায়েতপাড়া এলাকায় বিশেষ কায়দায় বেলুনে গ্যাস মজুদ রেখে ব্যবহার করে ওই এলাকার মানুষ। বিষয়টি তিতাস কর্তৃপক্ষের নজরে এলে ২০২১ সালের ৩০ মার্চ ওই এলাকার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর খাদুন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পরে দালাল চক্র আবার সেসব সংযোগ দিয়ে দেয়। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর আদুরিয়া ও মোহন এলাকায় পাঁচ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু দালাল চক্র মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ফের সংযোগ দিয়ে দেয়।

অবৈধ সংযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের যাত্রামুড়া কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘অবৈধ সংযোগগুলোয় নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় পাইপে লিকেজের সৃষ্ট হচ্ছে। ঘটছে বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান চলমান রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’