টাকা ছাপিয়ে গড়েছেন ভাগ্য
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:২১ এএম, ৭ নভেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টঙ্ক বা টাকা। টাকা ছাপা হয় গাজীপুরের দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-এ, যাকে বলা হয় টঙ্কশালা বা টাকশাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুদ্রাবাজারে নতুন ৪০ হাজার কোটি টাকার যোগান দেওয়া হয়। এ টাকা টাকশালে লুকোচাপা করে ছাপা হয়েছে। এর আগের দুই অর্থবছরেও বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপানো হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মোট ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে। এর বেশিরভাগই গত তিন অর্থবছরে ছাপা হয়েছে। তখন টাকশালের নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং তার দুই ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফোরকান হোসেন ও টাকশালের জেনারেল ম্যানেজার (প্রডাকশন) আশরাফুল আলমের হাতে। তারাই এ কাজ করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আব্দুর রউফ তালুকদার পদত্যাগ করলেও আশরাফুল আলম ও ফোরকান হোসেন ভালোভাবেই টিকে আছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানোর বিষয়টি চাউর হয়। অন্তবর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ টাকা ছাপানোর বিষয়টি সামনে আনেন। যারা লুকোচাপা করে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছেন তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। নাহলে ভবিষ্যতে অন্য কর্মকর্তারাও পদোন্নতি বা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে টাকা ছাপাতে আগ্রহী হবেন। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে ও পণ্যমূল্য হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। তখন সরকার চাইলেও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলে জানান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ড. জালাল উদ্দিন আহমেদ।
জানা গেছে, টাকশাল পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি বোর্ড আছে। বোর্ডের নির্দেশক্রমেই টাকশাল পরিচালিত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের এমডি বোর্ডের সদস্য। তবে টাকশালে টাকা ছাপানোর কাজ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জেনারেল ম্যানেজার (প্রডাকশন)। এ তিন কর্মকর্তাই মূলত টাকশালের নিয়ন্ত্রক।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে মুদ্রাবাজারে যোগান দেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপানো হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মোট ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়। এর মধ্যে বেশি টাকা ছাপানো হয়েছে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, টাকশালের এমডি ফোরকান হোসেন ও জিএম আশরাফুল আলমের দায়িত্বকালে। অর্থসচিব থেকে ২০২২ সালের ১১ জুন বায়লাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুর রউফ তালুকদার। গত ৯ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন, এখন লাপাত্তা। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ও ফোরকান হোসেন ভালোভাবেই টিকে আছেন।
আশরাফুল আলম ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি টাকশালে জিএম (প্রডাকশন) হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ফোরকান হোসেন ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি টাকশালের এমডি হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ফিরিয়ে নিয়ে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আশরাফুল আলমকে টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। তিনি ওই পদেই আছেন।
টাকা ছাপানোর বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার বিকালে টাকশালের এমডি আশরাফুল আলমের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
টাকা ছাপানো ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নিয়মিত কাজ। পুরানো ব্যাংকনোট তুলে নিয়ে নতুন ব্যাকনোট ছাপানো তাদের কাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা ছাপায়। প্রতি বছর কত টাকা ছাপানো হবে তার কোনো নিয়ম নেই। পুরো বিষয়টি দেশের অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। দেশের সম্পদ বাড়া-কমার উপর নির্ভর করে টাকা ছাপানোর বিষয়টি। যখন দেশের সম্পদ বাড়ে না, তখন টাকা ছাপালে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কোনো বিধি-বিধান মানেনি। ইচ্ছামত টাকা ছাপিয়েছে।
প্রতি বছর যে পরিমাণ টাকা অকেজো হয়, সে পরিমাণ টাকা ছাপানো যায়। টাকশালে প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন থেকে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন পর্যন্ত টাকা ছাপানো যায়। এর অতিরিক্ত পরিমাণে টাকা ছাপানোর প্রয়োজন পড়লে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার কথা টাকশালের। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর বিষয়টিতে লুকোচাপা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রাবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ড. জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার আয় এবং উৎপাদন বাড়ে না যখন তখন শুধু টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। টাকা ছাপালে এর সুবিধা পায় উচ্চ আয়ের মানুষ। কারণ তাদের আয় হয় বেশি। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ ও দরিদ্র মানুষ। কারণ তাদের আয় কম। মূল্যস্ফীতি বাড়লে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সুতরাং সরকার ইচ্ছা করলেই টাকা ছাপাতে পারে না। অর্থনীতির আয়তন মেনে টাকা ছাপাতে হয়। দেখা গেল, পণ্য বাড়েনি, অথচ অতিরিক্ত ১ হাজার ব্যাংকনোট ছাপানো হলো। তখন বাজারে টাকা বেড়ে যাবে। তখন ১ টাকার পণ্যের দাম হয়ে যাবে ২ টাকা বা তার বেশি। দাম বাড়লে যাদের টাকা আছে, তারা বেশি দামে কিনতে পারে। যাদের টাকা নেই তারা সমস্যায় পড়বে। অর্থনীতির আয়তন বাড়লে টাকা ছাপানোর প্রয়োজন হবে। মূল কথা হলো টাকা ছাপানোর অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে, সেসব ফ্যাক্টর মেনে টাকা ছাপাতে হবে। কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকার লুকোচাপা করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছেপে মুদ্রাবাজারে ছেড়েছে, এটা অর্থনীতির জন্য বিষফোঁড়া। বিদায়ী সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে মাত্রাতিরিক্ত যে ঋণ নিয়েছে তার ক্ষত এখনো অর্থনীতিতে বিরাজমান। অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় নেওয়া উচিত। নাহলে এটা অভ্যাসে পরিণত হবে। তখন সরকার চাইলেও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় বিভিন্ন সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ২২৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্রাতিরিক্ত টাকা ছাপানোর ফলে ২০২১ সাল থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। ওই বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প-আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।