বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসী বাংলাদেশিদের দৃষ্টিতে নির্বাচন

হাসান মাহমুদ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৭:১৯ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার


 
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্লাক, হিসপানিক ও মুসলিম ও কলেজগামী যুবকদের ভোট কোয়ালিশনে বিজয়ের মালা ঝুলেছে তার গলায়। অথচ এই কোয়ালিশনের ভোটেই অতীতে বারবার জয়ী হয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। প্যালেস্টাইন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সম্প্রদায় বাইডেন প্রশাসনের উপর ছিল ভীষন ক্ষুব্ধ। এ কারনে মুসলিমদের বড় একটি অংশ প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ভোটাধিকারকেই বেছে নেন। ইমিগ্রেশন ও অর্থনৈতিক ইসু্যুতে তরুন ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের কাছ থেকে। নানা সমীকরনে ট্রাস্প সিনেট ও হাউজ সহ নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে ক্ষমতায় যাচ্ছেন। এই নির্বাচন নিয়ে আজকালের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কয়েজন প্রবাসী বাংলাদেশি। তাদের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো।

 

 

 

‘মানবিক দুর্যোগের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না’
হাসান ফেরদৌস
আমাদের ভোটেই ট্রাম্পের জয় হয়েছে প্রাথমিক পরিসংখ্যান থেকে এখন পরিষ্কার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভাবিত ও অপ্রতাশিত বিজয়ের পেছনে একটি বড় কারণ সংখ্যালঘু কৃষ্ণকায়, বাদামী হিস্পানিক ও আমাদের মত বহিরাগতদের সমর্থন। আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এই গ্রুপের কাছ থেকে ট্রাম্প অধিক ভোট পেয়েছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশী আমেরিকান নাগরিকেরাও রয়েছেন। অন্যকথায়, আমাদের ভোটেই অভিবাসন-বিরোধী ও অভিবাসী-বিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পরদিন থেকেই তিনি এদেশে বসবাসরাত সোয়া কোটি বৈধ কাগজপত্র বিহীন - তাঁর ভাষায় অবৈধ - বহিরাগতদের জোরপূর্বক বহিষ্কার শুরু করবেন। প্রয়োজনে এই কাজে সেনা বাহিনীকেও ব্যবহার করবেন। প্রতি তিনজন বাংলাদেশীর একজন - বা হয়ত তারচেয়েও বেশি - বাংলাদেশী ‘অবৈধ’ এবং তারা ট্রাম্পের খেদাও অভিযানের শিকার হবেন। তারচেয়েও বড় কথা, আরো সোয়া কোটি অভিবাসী রয়েছে যাদের পরিবারের পিতা-মাতা অবৈধ হলেও তাদের সন্তানেরা এদেশে জন্মগ্রহণ করায় তারা বৈধ অভিবাসী। ট্রাম্পের খেদাও অভিযানে ছেলেমেয়ে এদেশে থেকে যাবেন, বহিষ্কৃত হবেন তাদের পিতামাতা। যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তারা এই অভাবিত মানবিক দুর্যোগ থেকে দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। যখন আপনার প্রতিবেশি, নিকট আত্মীয় অথবা পরিচিত বাংলাদেশীরা বহিষ্কৃত হবেন, আয়নায় নিজের চেহারে দেখে নিজের অপরাধ ঢাকতে পারবেন তো? কোন বহিষ্কৃত পিতামাতার সন্তানদের কান্না দেখে নিজেদের ক্ষমা করতে পারবেন তো?

 

 


জিতেও যেন হতাশ বাংলাদেশিরা!
 
ডা. সজল আশফাক

ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নির্বাচিত হতে পারেন এরকম একটা ধারণা কিন্তু শুরু থেকেই প্রচলিত ছিল। তার মূল কারণ ছিল বাইডেন প্রশাসনের কিছু ব্যর্থতা এবং ইউক্রেন এবং প্যালেস্টাইনের উপর ইজরাইলের বর্বর হামলায় সরাসরি সহযোগিতা করা। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একটা অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায় বেড়ে যায় দ্রব্যমূলের দামও। এছাড়া গণহারে অবৈধ অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়া এবং কিছু মাদকদ্রব্যকে সাধারণের কাছে সহজলভ্য করা এগুলোর কারণেও সাধারণের মাঝে কিছুটা ক্ষোভ ছিল বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে।  সাধারণভাবে বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে ডেমোক্রেটদের প্রতি সমর্থন বরাবরই একটি বেশি। উদ্ভূত এই বিরূপ নানাবিধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশি ডেমোক্রেট সমর্থকরা বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনায় মুখর ছিল। যে কারণে তারা বিকল্প কিছু একটা খুঁজছিল। ঠিক তখন প্যালেস্টাইনি দের উপর বর্বর হামলার নিন্দা করে মাঠে আসেন গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন। এ সময়ে অধিকাংশ মুসলিম ভোটারদের মুখে তার প্রতি সমর্থনের কথা শোনা যায়। অন্যদিকে শুধু বাংলাদেশিই নয়, আরব দেশের মুসলিম ভোটাররাও কামালা হ্যারিসের কাছ থেকে যুদ্ধবন্ধের ব্যাপারে আশ্বস্তসূচক কথা আশা করছিলেন। কিন্তু কামালা হ্যারিস তেমন কোন কথাই বললেন না। উল্টো নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিকে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প  যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে অস্পষ্ট এবং দিকনির্দেশনাহীন বক্তব্য রাখেন। যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই দিকনির্দেশনাহীন অস্পষ্ট বক্তব্যই অনেক মুসলমানদেরকে আশান্বিত করে। তাদের অনেকেই শেষ দিকে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন জানায় এবং তাকে ভোট দেয়। একই সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প হিন্দু ভোটারদেরকে কাছে টানতে বাংলাদেশ নিয়ে একটি টুইট করেন। সেই টুইটের পেছনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ইতিমধ্যে কিছু কিছু প্রমাণ মিলেছে। যা বাংলাদেশী হিন্দু ভোটার এবং আমেরিকায় আওয়ামী সমর্থকদেরকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছে।
এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা ব্যাপকভাবে মুসলমানদের ভোট হারিয়েছে। একই সাথে দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সাধারণের আস্থাও তাদেরকে হারাতে হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত নিন্দিত একজন ব্যক্তিত্ব বিপুলভাবে আমেরিকার নির্বাচনে জয়ী হবে তা কেউ কখনো ভাবেনি। ক্ষুব্ধ ডেমোক্রেট সমর্থক যারা ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা থার্ড পার্টিকে ভোট দিয়েছেন তারাও হতাশ হয়েছেন। কারণ তারা ডেমোক্রেটদের শিক্ষা দিতে যেয়ে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন বলে এখন মনে করছেন। ট্রাম্পের এই বিজয় ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সিনেট এবং হাউজ উভয়টিতেই রিপাবলিকানরা জয়ী হওয়ার কারণে ট্রাম্পের কর্তৃত্ব আরো শক্ত হয়েছে। ফলে ট্রাম্পের যেকোনো পাগলামো বাস্তবে রূপ নিতে বা প্রতিফলিত হতে খুব একটা সময় নেবে না। ট্রাম্পের এই বহুমাত্রিক বিজয় এখন মুসলিমদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। যে আশঙ্কার সূচনা হয়েছিল ট্রাম্পের বিগত শাসন আমলে। নানাভাবে মুসলমানদের উপর নানারকম বিধি-নিষেধ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে গোপনে আরোপ করা হতে পারে, বেড়ে যেতে পারে হেইট ক্রাইম। হোয়াইট সুপ্রিমেসির কারণে সাধারণের জীবনে নেমে আসতে পারে অধিকারবঞ্চিত জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা। ট্রাম্পের অধিকাংশ কথাবার্তাকেই মানুষ খেলো হিসেবে কিংবা মাঠের বক্তৃতা হিসেবে গ্রহণ করে। যুদ্ধবন্ধের ব্যাপারে ট্রাম্পের বক্তব্যটিও সেরকমই কিছু ছিল কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। রাজনীতির নোংরা খেলায় ট্রাম্প তৃতীয় বিশ্বের কোন নেতার চেয়েই কম যান না। কিন্তু রিপাবলিকানরা এবারের এই সমর্থন যদি ধরে রাখতে চান তাহলে কেন তারা জয়ী হয়েছেন সেটি বিবেচনা করে সে অনুযায়ী কিছু ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতের নির্বাচনে এই সমর্থন আরো দ্বিগুণ হয়ে বিপরীত পক্ষের দিকেই চলে যাবে তা বলাই বাহুল্য।  

 

বাইডেন সারা বিশ্বে আতংক তৈরি করেছেন
 
সামছুদ্দিন আজাদ


৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আশাকরি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি শক্তিশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। একই ভাবে জনগনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবেন। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন  সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে আতংক ও শঙ্কা তৈরি করেছেন। মানুষের মধ্যে বিভেদ, হিংসার বিষবাষ্প ছড়িয়েছন। নতুন প্রেসিডেন্ট যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারগুলোকে সহযোগীতা করবেন। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা ও অর্থনীতি সমৃদ্ধশালী করবেন, যাতে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন সহজ হয়।

 

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপুল বিজয় রীতিমত বিস্ময়ের
 
আদিত্য শাহিন

আমি প্রথমবারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি এবার। বিশ্বময় সবচেয়ে আলোচিত ও ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী ডামাডোলটা কাছ থেকে একেবারেই উত্তাপহীন। কখনো মনে হয়েছে এখানে প্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণ সবচেয়ে ক্ষমতাবান। আবার এও মনে হয়েছে জনগণকে বহু আগেই রাজনীতি থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে গণপ্রত্যাশাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকার নীতি বাস্তবায়নের প্রয়াসগুলো লক্ষ করেছি। মোটা দাগে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির জায়গাতে দুই প্রার্থীর কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা একই রকম। কেউ কেউ আলাদাভাবে ডেমোক্রেট প্রার্থী কমালা হ্যারিসকে ঘিরে নারী নেতৃত্ব, এশিয়ান, কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্বের সুফল নিয়ে ভেবেছেন। কিন্তু বর্তমানের মুল্যস্ফীতি, অভিবাসীদের অবাধ অনুপ্রবেশের অবসানের প্রশ্নে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরেকবার ক্ষমতায় দেখবার আশাও করেছেন। আর মানুষের সেই আশার বিবেচনা বিশ্ব শান্তির চেয়ে কম গুরুত্বের নয়। অনেকে বিশ্বাস করছেন ইসরাইল ফিলিস্তিনী এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটবে। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপুল বিজয় রীতিমত বিস্ময়ের। এটিই হয়তো গণতন্ত্রের চারণক্ষেত্র আমেরিকার রাজনৈতিক ম্যাজিক। আদিত্য শাহীন গণমাধ্যম কর্মী, নিউইয়র্ক