বুধবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৩ ১৪৩১   ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

‘বাবা আমি গুলি খেয়েছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৬:৩৭ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২৪ রোববার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

 

অভাব-অনটনের সংসার। তাই নাফিসা চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষে প্রবাসী মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরতে। কিন্তু তার এ ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। বুলেটের আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল তার স্বপ্নের আকাশ।

বলছিলাম সাভারের একমাত্র নারী শহিদ ও শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়ারের কথা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজার সামনে ঘাতকের একটি বুলেট নিস্তব্ধ করে দেয় রাজপথের অগ্রসৈনিক নাফিসাকে। বুলেট বুকের একপাশ ভেদ করে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে দুঃসাহসী নাফিসা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়ার সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজের এইসএসসির পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। পিতা চা দোকানি আবুল হোসেন (৫৪) এবং মা কুয়েত প্রবাসী কুলসুম বেগম (৪৪)। গ্রামের বাড়ী গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে। প্রথমে সাভারের মামার বাড়িতে থেকে সাভার ল্যাবরেটরি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে এইসএসসি পর্যন্ত পড়লেও পরবর্তীতে প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে বাবার কাছে গাজীপুরে এসে ভর্তি হন সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজে। মা কুলসুম বেগম ভাগ্য ফেরাতে চা দোকানি স্বামীকে রেখে কুয়েতে যাওয়ার পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নাফিসা হোসেন মারওয়া ছাড়াও সাফা হোসেন রাইসা (১২) নামের আরও একটি মেয়ে রয়েছে আবুল হোসেন-কুলসুম দম্পতির।

বাবা-মায়ের পৃথক অবস্থানের কারণে সাভারের কোটবাড়ি এলাকায় মামা হযরত আলীর বাড়িতে নানা-নানীর সাথেই থাকতো তাদের দুই মেয়ে। সেখানে থেকেই নাফিসা সাভার ল্যাবরেটরি কলেজে এইসএসসিতে এবং সাফা হোসেন রাইসা সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকার মাদ্রাসাতুল হাসনাহ’তে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। নাফিসা পরবর্তীকালে গাজীপুরের টঙ্গীতে চলে যান বাবার কাছে। সেখানে সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজ থেকেই অংশ নেন ২০২৪ সালের এইসএসসি পরীক্ষায়। ফলও বের হয়। উত্তীর্ণ হন জিপিএ ৪.২৫ পেয়ে। কিন্তু রেজাল্ট দেখার সৌভাগ্য হয়নি নাফিসার। তার আগেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন তিনি। সেই সাথে ধূলিসাৎ হয়ে যায় খুঁড়িয়ে চলা একটি পরিবারের স্বপ্ন।

শহিদ নাফিসার বাবা আবুল হোসেন মুঠো ফোনে বলেন, ‘আমার মেয়ে নাফিসা ছিল অত্যন্ত সাহসী। পড়াশোনায়ও ছিল ভালো। আমার সায় না থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই নাফিসা ছিল সোচ্চার। প্রতিটি আন্দোলনে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে ও রাজপথে থাকতো। আমার বাসা থেকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে গত ২৭ জুলাই নাফিসার বড় মামা হানিফ আলীর বাড়ী ঢাকার ধামরাইয়ে যায়। সেখানে  তিনদিন বেড়ানো শেষে ৩০ জুলাই চলে যায় ওর ছোট মামা হযরত আলীর বাড়ী সাভারের কোটবাড়ি এলাকায়। সেখানে থেকেই আগের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে যোগ দিত আন্দোলনে।

আবুল হোসেন বলেন, ওর মা’য়ের সাথে কথা না হলেও আমার মেয়ে নাফিসার সাথে আমার প্রায়ই কথা হতো। ঘটনার দিন গত ৫ আগস্ট দুপুরে হঠাৎই আমার মেয়ে নাফিসা আমাকে বলে, বাবা তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি টিভি দেখ, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নাকি পালাইছে, তখন আমি তাকে বলি মা আমরা গরীব মানুষ, আমি চা দোকানদার, আমাদের এসব দিয়ে কি হবে, তুমি বাড়ি চলে আসো, তখন আমার মেয়ে আমাকে বলে, ‘বাবা দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরবো না, আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো’। এর কিছুক্ষণ পর দুপুর আড়াইটার দিকে আবার আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা আমি গুলি খেয়েছি, আমি মনে হয় আর বাচঁবো না, আমি মারা যাচ্ছি, আমি ল্যাবজোন হাসপাতালে আছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’। তখন আমি বলি মা, তুমি যখন আমাকে ফোন দিতে পেরেছ, তাহলে তোমার মামাকেও ফোন দিতে পারবে, তুমি তোমার ছোট মামাকে একটা ফোন দাও, আমিও আসছি, তোমার কিছুই হবে না মা, বলেই আমি দোকান ফেলে দ্রুত সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আসতে আসতে পথিমধ্যে আমি আমার মেয়ের মোবাইলে ফোন দেই। তখন আমার মেয়ের মোবাইলটি অন্য কেউ রিসিভ করে আমাকে বলে, আপনি কে বলছেন, তখন উত্তরে আমি নাফিসার বাবা পরিচয় দিলে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আমাকে জানানো হয় আপনার মেয়ে আর নেই, মারা গেছে, লাশ এখন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে রয়েছে। আসার পথে সড়কের অবস্থা ভালো না থাকায় আমার আসতে খানিকটা দেরি হওয়ায় হাসপাতাল থেকে নাফিসার ছোট মামা হযরত আলী নাফিসার মৃতদেহ নিয়ে আসে। পরে আমাদের গ্রামের বাড়ী গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে কবরস্থ করা হয় নাফিসা’কে।

শহিদ নাফিসা হোসেন মারওয়ার একমাত্র ছোট বোন সাফা হোসেন রাইসা মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার বড় বোন ছিল অত্যন্ত ভালো। আমাকে অনেক আদর করতো। অনেক জেদি হলেও মনটা ছিল অনেক ভালো। কারও সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারতো না। রাগলেও পরক্ষণেই আবার হাসিমুখে কথা বলতো। আমার বোনের কথা অনেক মনে পড়ে। তবুও আমার বোন আর আসে না। বোনকে আমি কোথায় পাবো?’

শহিদ নাফিসার নানা সত্তরোর্ধ ইমান আলী বলেন, নাফিসা ছোটবেলা থেকেই ছিল অনেক জেদি আর সাহসী। যা বলতো তাই করতো। কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রায়ই যেত নাফিসা। যেতে নিষেধ করলেও কারও কথা শুনতো না। গত ৪ আগস্টও নাফিসাসহ ওর অন্য বন্ধুরা মিছিল নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আবার সাভার আসে। দুপুরে ওকে আমি ফোন দিয়ে বলি তুমি কোথায়, তখন ও বলে আমি সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে আন্দোলনে আছি। তখন আমি ওকে বাড়ি ফিরে আসতে বললে ও বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে। রাতে ও আমাকে পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট রোড মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচীতে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকার গাবতলী যাওয়ার কথা বললে আমি তাকে বলি তোমার যাওয়ার দরকার নেই, তুমি ওখানে কিছু চিনবে না। তখন নাফিসা আমার সাথে রাগ করে পরদিন ঢাকা যাওয়ার জেদ ধরে। সে অনুযায়ীই পরদিন ৫ আগস্ট সকাল বেলা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ওর ছোট মামা হযরত আলী ওকে ফেরাতে গেলেও নাফিসা অন্য পথ দিয়ে যাওয়ায় ওকে না পেয়ে বাসায় ফিরে আসে। নাফিসা এদিনও সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় এবং সেখান থেকে দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে মিছিল নিয়ে সাভার আসে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ায় কোন খোঁজ না পেয়ে আমি আমার ছোট নাতনি অর্থাৎ নাফিসার ছোট বোন সাফা হোসেন রাইসাকে নাফিসাকে আমার ফোন দিয়ে ফোন দিতে বলি। তখন অপর প্রান্তে নাফিসার ফোনটি অন্য কোন ব্যক্তি ধরলে আমার নাতনি তাকে বলে কে আপনি, আমার আপুর ফোন আপনি ধরছেন কেন, আমার আপুকে দেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলে তোমার আপুতো গুলি খেয়েছে, ও এখন পাকিজার সামনে সাভার ল্যাবজোন হাসপাতালে আছে। তখন আমার নাতনি আমার কাছে ফোন দিয়ে বলে নানা দেখ এই লোকটা যেন কি বলছে, আমি তো কিছুই বুঝছি না, তুমি দেখ। তখন আমি ফোন নিয়ে জিজ্ঞেস করি আমার নাতনি নাফিসার কি হয়েছে, তখন ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ওই ব্যক্তি আমাকে বলে আপনার নাতনি গুলি খেয়েছে, ল্যাবজোন হাসপাতালের তিন তলায় রয়েছে। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। তখন আমার ছোট ছেলে হযরত আলীকে নাফিসার গুলিবিদ্ধের খবর জানালে ও হাসপাতাল থেকে নাফিসার মৃতদেহ নিয়ে আসে।

শহিদ নাফিসার ছোট মামা হযরত আলী মুঠোফোনে জানায়, নাফিসা আমার কাছে থেকেই পড়াশোনা করতো। সম্পর্কে বোনের মেয়ে হলেও ওকে আমি মেয়ের মতোই স্নেহ করতাম। কিছুদিন হলো ও ওর বাবার কাছে গাজীপুর থেকে পড়াশোনা করছে।

মেয়ে হিসেবে নাফিসা অনেক সাহসী আর উদ্যমী ছিল উল্লেখ করে হযরত আলী আরও বলেন, পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিল নাফিসা। অত্যন্ত দুরন্ত নাফিসা ছিল চঞ্চলা। সবার সাথেই সুসম্পর্ক ছিল তার। আমিই ওর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসি। কোথা থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। নাফিসার মৃত্যুতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।

নাফিসার নানী আমেনা বেগম(৬৫) জানান, নাফিসা ছিল অনেক ভালো। ও ছিল অনেক দায়িত্ববান। মা বিদেশে থাকলেও নিজেকে কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হয় তা ও জানতো। এজন্য সবাই আমরা ওকে অনেক আদর ও স্নেহ করতাম। ভালোবাসতাম। আমাদের নাতনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ওর মায়া আমাদের আজও তাড়া করে ফেরে। ওর স্মৃতি কিছুতেই ভোলা যাবে না।

প্রবাসে থাকা শহিদ নাফিসার হতভাগ্য মা কুলসুম বেগম মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে এক মাসের মধ্যে কুয়েত থেকে ছুটে আসেন বাংলাদেশে। বার বার হাতড়ে ফেরেন মেয়ে নাফিসার স্মৃতি বই-খাতাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। তবুও ভুলবার নয় মেয়ে হারানোর বেদনা। ছলছল চোখে মেয়ে হারানোর শোক সইবার চেষ্টা করছেন।

কুলসুম বেগম বলেন, পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে আমি প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলাম। অভাব অনটনের সংসারে পড়ালেখা শেষে আমার সাথে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিল নাফিসা। কিভাবে ভুলি সেইসব স্মৃতি, আজ আমাদের সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

এদিকে, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা এবং বিএনপি’র পক্ষ থেকে ৫০হাজার টাকা আর্থিক অনুদান পেয়েছে নাফিসার পরিবার।
 
এছাড়া, শহিদ নাফিসা হোসেন মারওয়ার মৃত্যুর ঘটনায় নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।