বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সড়কই বিক্রি জেলা পরিষদের!

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:১৭ এএম, ১২ নভেম্বর ২০২৪ মঙ্গলবার

  • ৭০ ফুটে সড়কের আছে মাত্র ৩২ ফুট
  • নির্মিত হয়েছে ৭০টি দোকানঘর
  • প্রতিটি দোকান বিক্রি হয়েছে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায়

 

খুলনার চুকনগর বাজারের যতিন-কাশিম সড়ক ৭০ ফুট প্রশস্ত। তবে সেটি কাগজে-কলমেই। যাতায়াতের জন্য এখন আছে মাত্র ৩২ ফুট। বাকী ৩৮ ফুটে নির্মিত হয়েছে আধাপাকা দোকানঘর। বাজার এলাকায় সড়কের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে এমন ৭০টি দোকানঘর। অভিযোগ আছে, দোকান প্রতি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে সড়কের জায়গা ইজারা দিয়েছে খুলনা জেলা পরিষদ।

আর এ উপায়ে সাত কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে পরিষদের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। জেলা পরিষদে জমা পড়েছে যৎসামান্য জমি ইজারার মূল্য, আয়কর ও ভ্যাটের টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগের তদন্ত ও দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে অনিয়ম ও দুর্নীতির এ চিত্র উঠে এসেছে।

নথি ঘেঁটে জানা গেছে, চুকনগর হতে নওয়াপাড়া যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত (যতিন-কাশেম সড়ক) সড়কের দুইপাশ পাশের রেকর্ডীয় জমির মালিকরা দীর্ঘদিন ইজারা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল। ২০২১ সালে যানযট কমাতে সড়কটি সম্প্রসারণের কথা বলে সকল স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেলা পরিষদ। তবে উচ্ছেদের পর সড়কটি সম্প্রসারণ না করে ২০২২ সালে ওই জমি পুনরায় ইজারা দিতে দোকানঘর নির্মাণ শুরু করে সংস্থাটি। তখন ব্যবসায়ীরা দোকান নির্মাণে বাঁধা দেন। কিন্তু নির্মাণকাজ বন্ধ না করে উল্টো তাদের হয়রারি করা হয়।

পরে স্থানীয় ব্যবসায়ী পার্থ কুমার কুন্ডু এর প্রতিকার পেতে ও সড়কের দুপাশে দোকানঘর বন্ধে জাতীয় মানবধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তার অভিযোগ পেয়ে কমিশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা পরিষদ শাখাকে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ চিঠি দেয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ দোকানঘর বন্ধের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানে গত বছর ১৭ এপ্রিল খুলনা স্থানীয় সরকারকে চিঠি দেয়। এরপর খুলনা স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মো. ইউসুফ আলী তদন্ত শেষে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করে।

ডুমুরিয়া সহকারী কমিশনারের (ভূমি) বরাত দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার সংযোগস্থল চুকনগর বাজার। এ বাজারের প্রবেশ সড়ক যতিন-কাশেম সড়ক। আগে খুলনা-সাতক্ষীরা যাওয়ার ক্ষেত্রে সড়কটি ব্যবহার হত। সড়কটি ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর মৌজায় সিএস ৮৫১ নম্বর ও এসএ ২ নম্বর উভয় খতিয়ানে ১২৭ দাগে অবস্থিত। সিএস খতিয়ানে ওই জমি ‘জনসাধারনের ব্যবহার্য রাস্তা’, এসএ খতিয়ানে ‘রাস্তা’ নামে উল্লেখ রয়েছে। এসএ ১২৭ দাগের প্রস্থ ৭০ ফুট। যারমধ্যে এখন সড়ক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৩২ ফুট। সড়কের দুই পাশে ১৮ ফুট ও ২০ ফুট মোট ৩৮ ফুট জায়গায় টিনের ছাউনির পাকাঘর নির্মিত হয়েছে। সড়কের দুইপাশে লম্বা সারি সারি গড়ে তোলা হয়েছে দেকানঘর।

সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয়দের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কের দুইপাশে অবৈধ প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি গড়ে ওঠে। জনস্বার্থে সড়কটি সম্প্রসারণে জেলা প্রশাসককে ২০২০ সালে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে চিঠি দেয় জেলা পরিষদ। যার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালে অবৈধ অবকাঠামো উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের পর সড়কটি সম্পসারণে কোনো কার্যক্রমই গ্রহন করেনি জেলা পরিষদ। বরং সেই জমিতে ৭০ টিনের ছাউনির পাকা দোকানঘর নির্মাণ করে পুনরায় ইজারা প্রদান করেছে সংস্থাটি। অথচ জেলা পরিষদ সম্পত্তি (অর্জন, ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষন ও হস্তান্তর) বিধিমালা, ২০১৭-এর ১০ নম্বর অনুচ্ছেদের (২) উপ-বিধি (১) এ বলা হয়েছে, যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পরিষদের নিয়ন্ত্রণভুক্ত বা এখতিয়ারাধীন জনপদ বা সর্বসাধারনের ব্যবহার্য সম্পত্তি হস্তান্তর করা যাবে না।

তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্য ও ডকুমেন্ট অনুযায়ী কোনো ধরনের জনস্বার্থ রক্ষার্থে উক্ত জমিতে দোকানঘর নির্মাণপূর্বক জেলা পরিষদ পুনরায় প্রদান করেছে তা স্পষ্ট নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।

এ প্রসঙ্গে খুলনা স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, সড়কটি চওড়া ৭০ ফুট। সড়কটি সম্পসারণে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তবে সম্প্রসারণ না করে পুনরায় সড়কে দোকানঘর নির্মিত হয়েছে। ফলে জনস্বার্থ রক্ষিত হয়নি। বরং জনস্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে।

বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সড়ক ইজারা দিয়ে দোকানঘরপিছু ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ৭০টি ঘর থেকে তুলে নিয়েছে কমপক্ষে ৭ কোটি টাকা। এছাড়া নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একনামে একাধিক দোকানঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরিষদের সম্পত্তি সংস্থার চেয়ারম্যান, সদস্য বা কর্মচারীর নামে বা বেনামে অথবা তার আত্মীয়র নামে ইজারা নেওয়া বা ভাড়া নেওয়া যাবে না। কিন্তু ইজারাপ্রাপ্তদের তালিকায় পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান চৌধুরী রায়হান ফরিদের সন্তান চৌধুরী আবু জোবের রায়হান প্রনয় ও চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী বাবুল শিকদার ঘর পেয়েছেন।

দোকান গ্রহীতারা জানান, ইজারা গ্রহীতাদের শুধু জমির ইজারার কাগজ ছাড়া গৃহীত টাকার ডকুমেন্ট দেওয়া হয়নি। ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলেও জেলা পরিষদে জমা পড়েছে যৎসামান্য জমি ইজারার মূল্য, আয়কর ও ভ্যাটের টাকা। অর্থ্যাৎ এক বছরের জন্য সবচেয়ে ছোট আয়তনের ৭২ বর্গফুটের দোকানঘরের আয়কর ও ভ্যাটসহ ইজারামূল্য ৫ হাজার ১৮৪ টাকা। আর সবচেয়ে বড় ১৪৩ বর্গফুট আয়তনের দোকানঘরের আয়কর ও ভ্যাটসহ ইজারামূল্য ১০ হাজার ২৯৬ টাকা।

তদন্ত প্রতিবেদনে দোকানঘর ইজারাদার বিধান তরফদার জানান, ৬৭ ও ৬৮ নম্বর দোকানঘর তারা দুই ভাই বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যবসা করছেন। আরেক ইজারাদার মো. আক্তার হোসেন জানান, তিনিও ৬ নম্বর দোকানটি জেলা পরিষদ থেকে ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছেন।

এ প্রসঙ্গে চুকনগর বাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সেখ মো. মনিরুল হক ও দেবাশিষ কুমার দেশ রূপান্তরকে জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস এম মাহাবুবুর রহমান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জোরপূর্বক সড়কের দুইপাশে ৭০টি দোকানঘর নির্মাণ করে। প্রতিটি দোকানঘর থেকে তারা ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে। সড়কের দুইপাশে সারি দিয়ে দোকানঘর নির্মিত হওয়ায় রেকর্ডীয় মালিকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বাসা-বাড়িতে প্রবেশ পথ বন্ধ যায়। সামান্য প্রবেশ পথ কিনতেও তাদের ৫ লাখ করে টাকা দিতে হয়েছে।

এ ব্যাপারে খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজা রশীদ বলেন, ইজারার প্রদানের সময় তিনি এই জেলা পরিষদে ছিলেন না। ফলে কীভাবে ইজারা দেওয়া হয়েছে সেটি তার জানা নেই। তবে যোগদানের পর এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ পেয়েছেন। সর্বশেষ ৫ আগস্টে জেলা পরিষদ ভবণে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুনে সব কাগজ পুড়ে গেছে। এখন কোনো কাগজপত্র বা নথি নেই।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ এবং প্যানেল চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি চৌধুরী রায়হান ফরিদের মোবাইল নম্বরে বার বার ফোন করেও বন্ধ পাওয়া গেছে।