১১ মিল মালিকের সিন্ডিকেটে চালে অস্থিরতা
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:২৯ এএম, ২১ নভেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার
প্রশাসনের সতর্ক নজরদারির পরও দেশের বৃহত্তম মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে কমছে না চালের দাম। যার প্রভাব পড়েছে কুষ্টিয়াসহ দেশের বড় একটি অংশের খুচরা বাজারে। নতুন ধান ওঠার পর চালের দাম যেখানে কমার কথা, সেখানে উল্টো কুষ্টিয়ার বাজারে মোটা-চিকন সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে অন্তত ৪ টাকা করে। এতে ভোক্তাপর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
সাধারণ ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা বলছেন, একটি চক্র কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে। আর এই চক্র গড়ে উঠেছে ১১টি স্বয়ংক্রিয় বা অটো রাইস মিল মালিকের সমন্বয়ে। যাদের মধ্যে আবার আটজনই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারিত দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দফায় দফায় সভা করেও চালের দরের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। উল্টো যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ছে চালের দাম। যদিও চালের বাজারে অস্থিরতা রুখতে প্রশাসন সজাগ নজরদারি করছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মাসের শুরুর দিকে যখন নতুন ধান ওঠেনি, তখন খুচরা বাজারে যেসব মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৮ টাকা ছিল, বর্তমানে নতুন ধান থেকে উৎপাদিত সেই মোটা চাল প্রতি কেজি ৫২ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। একই চিত্র চিকন বা সরু চালেরও। খুচরায় যে চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৬৭-৬৮ টাকা, সেই চাল এখন কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭২ টাকায়। অথচ চলতি আমন মৌসুমে বাম্পার ফলনের পর বাজারে নতুন ধানের বিপুল সরবরাহ রয়েছে। গত মঙ্গলবার সদর উপজেলার বিত্তিপাড়া বাজারে প্রতি মণ মোটা ধানের বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ২২০ থেকে ১ হাজার ২৬০ টাকা। আর চিকন বা সরু ধানের মণপ্রতি বাজারদর ১ হাজার ৩১০ থেকে ১ হাজার ৩৩০ টাকা পর্যন্ত।
মিলসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মণ এসব ধান থেকে গড়ে মানসম্মত চাল উৎপাদন হয় ২৬/২৭ কেজি। প্রতি এক মণ ধান থেকে উৎপাদিত মানসম্মত চাল ছাড়া অবশিষ্ট খুদ, কুড়া, রাইসব্যান মিলে ১৩/১৪ কেজি বায়ো প্রডাক্ট হয়, যা মিল গেটে গড়ে প্রতি কেজি ৩০/৩২ টাকা দরে বিক্রি হয়। প্রতি মণ ধান থেকে চাল উৎপাদনে মিলিং (কারখানাব্যয়), প্যাকিং ও বাজারজাতকরণে খরচ হয় প্রায় ২০০ টাকা।
কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের খুচরা চাল বিক্রেতা আবুল হাশেম বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই চালের বাজার ঊর্ধ্বগামী। আমরা কাস্টমারকে বলছিলাম, এই কয়টা দিন অপেক্ষা করেন, নতুন ধান উঠলেই বাড়তি দাম কমে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি তার উল্টো, মিলাররা বলছেন, বাজারে ধানের দাম বাড়তি, তাই চালের দামও বাড়তি। কাকে কী বলি? এসব দেখারও কেউ নেই।’
সদর উপজেলার খোর্দ আইলচারা গ্রামের কৃষক আসাদুল হক বলেন, ‘ধানের বাজারদর হিসাবে প্রতি কেজি মোটা চালে সব হাত বদলে কেজিপ্রতি ২ টাকা লাভ ধরেও কোনোভাবেই দাম সর্বোচ্চ ৪৫ টাকার বেশি যাওয়ার কথা না আর চিকন চালের ক্ষেত্রেও প্রতি কেজি ৫২/৫৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। কারণ বর্তমানে ধান থেকে চাল ছাড়াও খুদ, কুড়া, রাইসব্যানসহ সবকিছুই বিক্রি হচ্ছে। ওই টাকাতেই তো সব খরচ বাদ দিলেও লাভের টাকা বেরিয়ে আসে।’
যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই চালের দাম বাড়ছে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কুষ্টিয়ার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা জাতিগতভাবেই সুযোগসন্ধানী। এই ভরা মৌসুমে কোনো কারণ ছাড়াই চালের বাজার ঊর্ধ্বগামী হয় কী করে? ধানের বাজারদর এবং চালের বাজারদরে যে অস্বাভাবিক ফারাক, তার লাগাম টেনে ধরতে হলে কিছু কার্যকর উদ্যোগ অবশ্যই দরকার। যেমন : প্রকৃত অর্থে কৃষকপর্যায়ে উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে ধানের বাজারদর নির্ধারণ করে তা কার্যকর রাখতে হবে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় মিলারদের সঙ্গে কৃষি বিপণন বিভাগের সমন্বয়ে চুলচেরা হিসাব করে চালের দাম কত হওয়া উচিত, সেটা নির্ধারণ করে তা প্রতিপালনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আর কেউ চাইলেই হুট করে রাতারাতি ইচ্ছেমতো চালের দাম নিয়ে কারসাজি করতে পারবেন না।’
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে কয়েকটি কারণ বেরিয়ে এসেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো খাজানগরের আওয়ামী লীগপন্থি আট মিল মালিকের কারসাজি। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে দলীয় পদ-পদবিধারী এই মিল মালিকরা চাল ব্যবসার বাইরেও জেলা জুড়ে বিভিন্ন খাতে রাজত্ব করেছেন। এখনো ধান-চালের বাজারের মূল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই।
এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে রয়েছে অর্ধশত অটো রাইস মিল। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের চালের বাজারে যে মিনিকেট (চিকন/সরু) চাল যায়, তার ৮০ ভাগই কুষ্টিয়ার ৩১টি অটো রাইস মিল থেকে সরবরাহ হয়। তবে এতগুলো অটো মিল থাকলেও কার্যত ১১ মিল মালিকের হাতে পুরো খাজানগরের নিয়ন্ত্রণ। তাদের মধ্যে আটজন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। খাজানগরের সব মিলে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়, তার সমপরিমাণ চাল উৎপাদন করে থাকেন এই ১১ মিল মালিক এবং প্রায় ৬০ শতাংশ ধান-চাল মজুদও থাকে তাদের গুদামে। সাধারণ মিল মালিকদের অভিযোগ, বৃহৎ এসব মিল মালিকের কলকাঠিতে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাজানগরে ধান-চালের মোকামে রাজত্ব করেন রশিদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের আব্দুর রশিদ, সুবর্ণা রাইস মিলের জিন্নাহ, দেশ এগ্রো ফুডের আব্দুল খালেক, স্বর্ণা রাইস মিলের আব্দুস সামাদ, গোল্ডেন রাইস মিলের জিকু, জাফর এগ্রো ফুডের আবু জাফর, ফ্রেশ এগ্রো ফুডের ওমর ফারুক, দাদা রাইস মিলের আরশেদ আলী, প্রগতি রাইস মিলের হযরত আলী, ফোর স্টার রাইস মিলের মফিজ উদ্দিন ও ব্যাপারী রাইস মিলের তোফাজ্জেল ব্যাপারী। তাদের মধ্যে ফ্রেশ এগ্রো ফুডের মালিক ওমর ফারুক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, জাফর এগ্রো ফুডের মালিক আবু জাফর কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক, ফোর স্টার রাইস মিলের মালিক মফিজ উদ্দিন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সুবর্ণা রাইস মিলের মালিক জিন্নাহর ছেলে রাজীব আহম্মেদ নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাবেক সহসভাপতি।
আরও চারজন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের অতি আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। দেশের চাল সিন্ডিকেটের হোতাখ্যাত আব্দুর রশিদও ছিলেন মাহবুবউল আলম হানিফের অতি আস্থাভাজন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাহবুবউল আলম হানিফকে ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছেন দেশ এগ্রো ফুডের আব্দুল খালেক ও প্রগতি রাইস মিলের হযরত আলী। জেলা খাদ্য অফিসের নিয়ন্ত্রণও ছিল তাদের হাতে। হানিফের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল দেশ এগ্রো ফুডের আব্দুল খালেকের। দুজনের বাড়িতে দুজনের নিয়মিত ছিল যাতায়াত। হানিফকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ অনেককে ঘায়েল করেছেন খালেক। এ ছাড়া দাদা রাইস মিলের আরশেদ আলীও আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত। হানিফ ও তার ভাই আতার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এই আরশেদ।
সুবর্ণা রাইস মিলের মালিক জিন্নাহর দুই ছেলেই নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বড় ছেলে রাজীব আহমেদ কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। শান্তির মোড়ে সুবর্ণা রাইস মিলের প্রধান কার্যালয়। ওই কার্যালয়ের দোতলায় আলাদা একটি কক্ষ রয়েছে। যে কক্ষের জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়ে দুটি কাঠের চেয়ার তৈরি করেন জিন্নাহ। সেই চেয়ার দুটি সংরক্ষিত ছিল শুধু মাহবুবউল আলম হানিফ ও তার ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার জন্য।
অন্যদিকে ফ্রেশ এগ্রোর মালিক ওমর ফারুক আওয়ামী লীগ আমলে কুষ্টিয়ার নিয়ন্ত্রকখ্যাত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কোনো দিন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও আতার আস্থাভাজন হিসেবে রাতারাতি হয়ে যান কুষ্টিয়া সদর থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ।
সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের পর বেড়ে যায় চালের দাম। এরপর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। আরেক দফা বেড়েছে দাম। মজুদ নিয়মের ধার না ধরে হাজারো টন ধান-চাল গুদামে ভরে রেখেছেন আওয়ামী লীগপন্থি এসব মিলার।
দেশ এগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকার আব্দুল খালেক সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করলেও এর সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘চালের বাজারদর বৃদ্ধি হলেই শুধু খাজানগরের মিলাররা দায়ী তা নয়; দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ১০টি করপোরেট কোম্পানি। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
চালের দাম ঊর্ধ্বমুখীর জন্য মিলারদের বিরুদ্ধে কারসাজির যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা অস্বীকার করেন কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান। তিনি বলেন, ‘এখনো নতুন ধান পুরোপুরি বাজারে ঢোকেনি। এই মৌসুমের ধান সব বাজারে চলে এলে দাম কিছুটা কমে আসবে।’
এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তৌহিদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিয়মিত মিলারদের সঙ্গে মিটিং হচ্ছে। তারা চালের বাজারকে স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। চালের বাজার অস্থির করতে কোনো সিন্ডিকেট হতে দেওয়া যাবে না।’