রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিশ্বে যেভাবে ‘নির্যাতিত’ হচ্ছেন পুরুষরা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১০:০৮ এএম, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ রোববার

‘কত পুরুষ যে তার স্ত্রী বা প্রেমিকার হাতে খুন হন অথবা নারীরা তার ‘অবৈধ’ প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে স্বামী বা প্রেমিককে খুন করেন, বাড়িতে নিভৃতে মার খান স্ত্রীর কাছে, মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, সেই হিসাবই পাবেন না আপনি। লিঙ্গ-ভিত্তিক অপরাধের যে তথ্য রাখা হয়, সেখানে নারীদের ওপরে কী কী অপরাধ সংগঠিত হল, তার সংখ্যা পাবেন। কিন্তু পুরুষরা যখন কোনো অপরাধের শিকার হন, সেটার লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যান আর আলাদাভাবে রাখা হয় না।’

এমনটি বলছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা ও ভারতে পুরুষ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ।

তার মতে, ভারতে ধর্ষণের শিকার হওয়া এবং অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের সংখ্যা বিশাল। তবে একটা বড় সংখ্যার পুরুষের বিরুদ্ধেও ধর্ষণ এবং বধূ-নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করা হয়ে থাকে। তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারিভাবে পাওয়া যায় না, তবে নানা সময়ে এইসব মিথ্যা অভিযোগের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। ভরদ্বাজ বা নন্দিনী ভট্টাচার্যদের মতো পুরুষ অধিকার কর্মীরা এমন একাধিক ঘটনা সামনে এনেছেন।

আবার কেনিয়ার পুরুষ অধিকার আন্দোলনের নেত্রী রোজম্যারি কিনুথিয়া বলছিলেন, ‘আফ্রিকার পুরুষদের সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা চিরাচরিতভাবে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে মনে করে এসেছে। তাদেরই দায়িত্ব নারীদের রক্ষা করা– এমন একটা ভাবনা সবারই আছে। কিন্তু সেই পুরুষই স্ত্রী বা প্রেমিকার হাতে ঘরের ভেতরে মার খাচ্ছে, এটা লজ্জায় তারা বলতে পারে না।’

‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বহু পুরুষ এখন আর বিয়েই করতে চাইছেন না। কেনিয়াতে তাই একাকী-মায়ের সংখ্যাটা বিশাল। আবার কারাগারগুলো উপচিয়ে পড়ছে, বহু পুরুষ মানসিক অবসাদের কারণে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে – তাদের জেল হচ্ছে,’ জানাচ্ছিলেন কিনুথিয়া।

পৌরুষের অহংকার

এই প্রতিবেদনের জন্য পুরুষ-অধিকার আন্দোলনের যেসব নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবার ক্ষেত্রেই একটা বিষয় উঠে এসেছে যে নির্যাতনের কথা শিকার করতে পৌরুষে বাধে।

অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরামের প্রধান নন্দিনী ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘কোনো একজন নারীকে যদি কোনো পুরুষ সহকর্মী আদিরসাত্মক মেসেজ পাঠান, তাহলে তা নিয়ে যেরকম শোরগোল পড়ে যায়, একজন নারী সহকর্মী যদি একই ধরনের মেসেজ পাঠান কোনো পুরুষ সহকর্মীকে, তাহলে কী সেই পুরুষটি অন্যদের বলতে যাবেন? কোথাও অভিযোগ জানাতে যাবেন? কখনই না।’

‘ব্যাপারটা জানাজানি হলে অন্য পুরুষ সহকর্মীরা হয়তো মস্করা করবেন। কিন্তু তিনি তো ব্যাপারটা উপভোগ নাই করতে পারেন! তাই বিষয়টা চেপে যান একজন পুরুষ। তার পৌরুষে হয়তো কোথাও লাগে। তবে পুরুষেরও যে সম্ভ্রম আছে, তারও যে সম্ভ্রমহানি হতে পারে, সেটা তো কেউ ভাবেনই না।,’ বলছিলেন ভট্টাচার্য।

দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ উদাহরণ দিচ্ছিলেন ভারতের পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার প্রশ্নাবলীর। ওই সমীক্ষায় পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য প্রশ্ন থাকে যে ‘আপনার স্বামী মারধর করেন কী না। আবার আপনি স্বামীকে মারধর করেন কী না, সেটাও জানতে চাওয়া হয়। তবে পুরুষদের জন্য কিন্তু প্রশ্নটা থাকে না যে আপনি স্ত্রীর হাতে মার খান কী না! ভরদ্বাজ বলছিলেন, যেকোনো পুরুষ এই তথ্য দিতে চান না যে তিনি স্ত্রীর হাতে মার খেয়েছেন, তবে অনেক নারী কিন্তু ওই প্রশ্নের জবাবে বলেন যে তিনি তার স্বামীকে মারধর করেন।

কেনিয়ার কিনুথিয়াও বলছিলেন, আফ্রিকায় চিরাচরিতভাবে যে ধারণা রয়েছে যে পুরুষরাই নারীদের রক্ষাকর্তা, তারাই শক্তিমান, সেই জায়গাটা থেকে সরে এসে কী করে একজন পুরুষ স্বীকার করবেন যে তিনি স্ত্রী বা প্রেমিকার দ্বারা নির্যাতিত হন!

পুরুষ-নারী অধিকার আন্দোলন কি সাংঘর্ষিক?

আফ্রিকার পুরুষ অধিকার আন্দোলনের রোজম্যারি কিনুথিয়া বলছিলেন, নারীবাদী এবং নারী আন্দোলনের কর্মীরা তাকে রীতিমতো ‘ঘৃণা’ করেন। বিশ্ব পুরুষ দিবসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক জেরেমি তিলকসিং-ও বলছিলেন, তাদের আন্দোলন নিয়ে নারীবাদীদের প্রবল সমালোচনা শুনতেই হয়।

তার কথায়, ‘নারীবাদীরা মনে করেন যে আমাদের দাবিগুলোর সঙ্গে তাদের চিন্তাধারার সংঘর্ষ আছে। কিন্তু ব্যাপারটা তো তা নয়। আমরা তো নারীদের বিরোধিতা করছি না। আমরা চাইছি লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠুক, একটা সুস্থ পরিবার গড়ে উঠুক।’ তবে ভারতের নারী আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে পুরুষ অধিকার আন্দোলনের সম্পর্কটা অতটা সাংঘর্ষিক নয় বলেই দাবি করছিলেন নন্দিনী ভট্টাচার্য।

‘অন্তত এখানে যারা নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে আমার ভীষণ সুসম্পর্ক আছে। আমরা একসঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে, সেমিনারে বক্তব্য রাখি। নারীদের জন্য ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বেই এখনও অনেক কিছু করা বাকি আছে। তবে পুরুষদের জন্য তো কিছুই নেই, তাদের জন্য তো কাজ একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। তাই নারী আন্দোলন কর্মীদের সঙ্গে আমাদের কোথাও কোনও বিরোধ নেই। তাদেরটা তাদের আন্দোলন, আমাদের লড়াইটা আমাদের,’ বলছিলেন নন্দিনী ভট্টাচার্য।

তিনি এও বলছিলেন যে নারী আন্দোলনের কর্মীরাও এখন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেছেন লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতেই আইনি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।

তবে কী বলছেন নারী আন্দোলনের কর্মীরা? তারা কী চোখে দেখেন পুরুষ অধিকার আন্দোলনকে?

পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী শাশ্বতী ঘোষের কথায়, ‘নারী হোন বা পুরুষ, যে কোনও অধিকার আন্দোলনকেই আমি সমর্থন করি। যেকোনও গোষ্ঠীই বঞ্চিত বা নির্যাতিত হলে তাদের আন্দোলনকে স্বাগত। তবে যে বিষয়টা তারা তুলে ধরেন যে সব আইনগুলোই নারীদের দিকে, সে ব্যাপারে আমার কিছু বক্তব্য আছে।’

‘সেই আইনগুলোর প্রয়োগ যারা করছেন, তারা কিন্তু মনে করেন না যে নারীদের সব অধিকার দিয়ে দেওয়া উচিত। মানবাধিকার সচেতন বিচারপতি হিসাবে যিনি বিখ্যাত, সেই ভি আর কৃষ্ণ আয়ারের মতো মানুষও মন্তব্য করেছিলেন যে পরিবারের মধ্যে, বাড়ির ভেতরে সাংবিধানিক সমতা চলতে পারে না। তার মতো মানুষ যখন এধরনের মন্তব্য করেন, ঘটনাচক্রে যিনি একজন পুরুষ, তাহলে তো সাধারণ পুরুষরা ভেবেই নেবেন যে নারীদের বাড় বেড়েছে, তাদের অধিকার থাকা উচিত নয়,’ বলছিলেন শাশ্বতী ঘোষ।

তবে পুরুষ অধিকার ও নারী অধিকার আন্দোলন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বলে তিনি মনে করেন না। তার কথায়, ‘এখানে কোনো সংঘর্ষ আছে বলে আমি মনে করি না। তাতে অকারণ শক্তি ক্ষয় হবে। আমরা যাতে সবাই সমান অধিকার পেতে পারি, সেটা তুলে ধরা দরকার। আবার অধিকারের সঙ্গেই দায়িত্বটাও চলে আসে। আমি যেমন অধিকার চাইব, তেমনই দায়িত্বও নিতে হবে। যদি অধিকার আর দায়িত্ব দুটোই সমান ভাবে ভাগ করে নিতে পারি আমরা, তাহলে নারী ও পুরুষ অধিকার আন্দোলনের মুখোমুখি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না। দুটোই পরস্পরের পরিপূরক।’

বিশ্ব পুরুষ দিবসের প্রাক্কালে জেরোম তিলকসিংও বলছিলেন যে নারী-পুরুষ উভয় মিলেই লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে আগামী দিনে একটা স্বাভাবিক সমাজ গড়ে উঠুক।