বাংলাদেশবিরোধী গুজব ছড়ানো হচ্ছে ভারত থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৩১ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার
ভারতীয় চ্যানেল রিপাবলিক টিভির খবরে গত মঙ্গলবার দাবি করা হয়, গ্রেপ্তার চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হয়েছেন পুলিশের হামলায়। গত ৬ নভেম্বর ইন্ডিয়া টুডে টিভির খবরে বলা হয়, প্যারিসে পালিয়ে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই দিন রিপাবলিক বাংলা টিভিতে দাবি করা হয়, চট্টগ্রামে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হামলায় তিন হিন্দু নিহত হয়েছেন, আহত ৮০ জন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শুরু থেকেই ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে একের পর এক বাংলাদেশবিরোধী গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তা আরও বেড়েছে। ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইউটিউবে ছড়ানো হয়েছে গুজব। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী দাবি করে খবর প্রচারের আগ পর্যন্ত কিছুই করেনি। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ফ্যাক্ট চেকে এর আগে একাধিক খবরকে ভুয়া চিহ্নিত করে তা ফেসবুক পেজে জানানো হয়।
এএফপি বাংলাদেশ ব্যুরোর প্রধান ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির সমকালকে বলেছেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে শুরু থেকেই ইসলামী উগ্রপন্থার উত্থান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, এমন বয়ান তৈরি করছে। কদরুদ্দিন শিশির ৬ আগস্ট সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস-সংক্রান্ত ভারত থেকে ছয়টি গুজবের ফ্যাক্ট চেক করেন।
তিনি সমকালকে বলেছেন, যত সময় যাচ্ছে গুজব তত বেশি ছড়াচ্ছে, সামাজিকমাধ্যম থেকে ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমে যাচ্ছে। এর পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাচ্ছে, যা উদ্বেগের। এসব গুজব হলেও, বাংলাদেশের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধ ছিল, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কোনো পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের হাতে বিলিয়ন ডলার রয়েছে, তারা মিথ্যা এবং অপতথ্য ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। তারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রে বিরাট সংখ্যক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রয়েছে। তাদের তৃতীয় প্রজন্ম প্রশাসন, ব্যবসাসহ অনেক জায়গা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। তারা এসব মিথ্যা ও অপতথ্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম।
এর মোকাবিলায় শুধু সামাজিকমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেক বা সরকারের বিবৃতি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন কদরুদ্দিন শিশির। তিনি বলেছেন, এর রেসপন্স হবে পদ্ধতিগতভাবে। সরকারকে গুজবের উৎস চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রিউমার স্ক্যানারের হেড অপারেশন সাজ্জাদ এইচ চৌধুরী সমকালকে জানান, ৫ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিকমাধ্যমে ছড়ানো ৪০টি গুজব চিহ্নিত করা হয়। এসব গুজবের প্রায় সবগুলো ছিল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছড়ানো। পুরোনো ছবি, ভিডিও দিয়ে দাবি করা হয়, এগুলো বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা।
গত মঙ্গলবার রাতে এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করা ভিডিওতে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের রাস্তায় পেটানো হচ্ছে। যদিও ভিডিওটি গত সোমবার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ এবং সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের। একই ভিডিও দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এক্স হ্যান্ডে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে হিন্দুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘরে হামলা করে আগুন দেওয়া হচ্ছে।
রিউমার স্ক্যানার সমকালকে জানিয়েছে, সাম্প্রদায়িক গুজব ছাড়াও সম্প্রতি ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশবিষয়ক সাতটি গুজব ছড়ানো হয়। গত ১৫ নভেম্বর রিপাবলিক বাংলা টিভিতে দাবি করা হয়, পাকিস্তান থেকে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ এসেছে বাংলাদেশে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের। কিন্তু সেই জাহাজে আলু, পেঁয়াজ ছাড়াও গার্মেন্টে ব্যবহৃত রাসায়নিক এসেছিল।
ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম জি-নিউজ ৭ আগস্ট ‘জেএমবি-হুজিসহ একঝাঁক জঙ্গি সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দাবি করা হয়, হুজি, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ, শাহদত-ই-আল হিকমা, হিযবুত তাহ্রীরসহ একাধিক নিষিদ্ধ সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের নির্দেশে জইশের ১২ জন, লস্কর-ই-তৈয়বার ৪ জন, হিজবুত তাওহিদের ১৫ জন, আনসারুল্লা বাংলা টিমের ১৮, আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের ৪ জন, আল হিকমার ১২, জেএমবির ২৮, হুজির ২২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একই গুজব কলকাতার ‘বার্তা টুডে’ এবং ‘এই মুহূর্ত’ থেকে ছড়ানো হয়।
ভারতের নিউজ ব্রডকাস্টিং এবং ডিজিটাল স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি (এনবিডিএসএ) নামের স্বাধীন সংস্থা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান গত এক বছরেই ভারতের অন্তত তিনটি শীর্ষ টিভি চ্যানেলকে শাস্তি দিয়েছে ভুয়া খবর প্রচারের জন্য। বাংলাদেশ-সংক্রান্ত ছড়ানো ভুয়া খবর প্রচারের জন্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে এনবিডিএসএসের মুখোমুখি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ফ্যাক্টচেকাররা। তারা বলছেন, এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। সরকারের হয়ে দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন করবে।
একাধিক অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক সমকালকে বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভুত্থানের মুখে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি টেনে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনার কারণে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার চলছে। হাজারো ছাত্র-জনতাকে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। দিল্লি তাঁকে সাময়িক আশ্রয় দিলেও নিরাপদ তৃতীয় দেশের সন্ধানে রয়েছে। ভারতের ওপর একদিকে শেখ হাসিনাকে সুরক্ষা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অন্যদিকে বিশ্বের কাছে হাজারো নিরস্ত্র বাংলাদেশি হত্যার হুকুমদাতাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণ ও তাঁর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে উত্তর দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় নিজের ওপর থেকে চাপ কমাতে, যে কোনো উপায়ে বাংলাদেশকে উল্টো চাপে রাখতে দিল্লি সংখ্যালঘু নিপীড়নকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করেছে বলে অভিমত কূটনীতিক বিশ্লেষকদের। তাদের ভাষ্য, এ কারণেই বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থিদের উত্থান বলে দেখাতে চাইছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিশ্ব গণমাধ্যম যখন ভারতের অপপ্রচার নিয়ে খবর পরিবেশন শুরু করল, ভারত সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে নিরাপত্তাকে সামনে আনে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুটি ডানা রয়েছে। একটি সাম্প্রদায়িকতা, আরেকটি নিরাপত্তা। ৫ আগস্টের পর সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে যখন তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারল না, তখন নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। সেটিও খুব সুবিধা করতে পারেনি। ফলে আবারও সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলা শুরু করেছে। সেই সঙ্গে তাদের গণমাধ্যমের মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য, ভুয়া তথ্য বা বিকৃতভাবে তথ্য উপস্থাপন করে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে খাটো করছে, যা হাসিনা আমলে দেখা যায়নি।
পশ্চিমা দেশের একটি দূতাবাসের রাজনৈতিক বিভাগের এক কূটনীতিক নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার গঠনের পর বেশ কিছু শিল্প উদ্যোক্তা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল। তবে শেষ মুহূর্তে তারা সফর বাতিল করে। তখন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বাংলাদেশের বিষয়ে ভীত। তারা মনে করছে, এখানে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ঢাকায় নিযুক্ত এই কূটনীতিক বলেছেন, মূল সমস্যা বাংলাদেশে পর্যাপ্ত ইংরেজি সংবাদমাধ্যম না থাকা। আর যা রয়েছে, তাদের ভারতের ছড়ানো গুজব, অপতথ্যকে খণ্ডন করতে দেখা যায় না। এর পাশাপাশি বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা এশীয় আঞ্চলিক প্রধানরা ভারতীয় বংশদ্ভূত বা ভারতীয়। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফোনে আমার সুস্থতার খবর নিয়েছেন। কারণ সিঙ্গাপুরে তাঁর আঞ্চিলক কার্যালয়ের প্রধান, যিনি ভারতীয়, তিনি খবর দিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই নাজুক।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচারের ১০০ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনকে অপপ্রচার নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেছে। এর জবাবে ভারতীয় হাইকমিশনার শুনিয়েছেন, তাঁর দেশের গণমাধ্যম মুক্ত। দিল্লি সরকারের কিছু করার নেই।
গত ২১ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে মুখপাত্র তৌফিক হাসান বলেন, ভারতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে যে অপপ্রচার চলছে, সেটি আমরা বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনকে বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছি। তাদের জানিয়েছি, দুই দেশের পারস্পরিক যে সম্পর্ক রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের অপপ্রচার মোটেই কাম্য নয়।
গত মঙ্গলবার রাতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের খবরেও দাবি করা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী ছিলেন সাইফুল ইসলাম আলিফ। সরকার অপতথ্য প্রতিরোধে কিছুই করছে না; এ অভিযোগ ওঠার পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে জানিয়েছেন, কীভাবে ভুল তথ্যকে খণ্ডন করে রয়টার্সের খবরে সংশোধন আনা হয়েছে।