বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১   ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিএনপির প্রস্তাবে নিজেদের বদলও

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৪ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

  • নিজেরা বাতিল করা উপ-রাষ্ট্রপতি উপ-প্রধানমন্ত্রী ফেরাতে চায় দলটি
  • ফ্লোর ক্রসিংয়েও সংশোধনের প্রস্তাব

 


সরকার ও অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় থাকা সত্ত্বেও জনসাধারণের মধ্যে দলের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি এবং আস্থা তৈরির জন্য সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহার করে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চাচ্ছে বিএনপি।

দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি যে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন করতে পারে এবং আবারও ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড অনুকরণ করবে না, এটি প্রমাণ করার মাধ্যমে এখন জনগণের আস্থা অর্জন করাই তাদের লক্ষ্য। এজন্য ইতিবাচক কর্মকাণ্ড, বিবৃতি ও দলীয় আচরণের মাধ্যমে দলের সুনাম বাড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করছে দলটি। আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা যেন জেঁকে বসতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিতে চায় একাধিকবার সরকারে থাকা দলটি।

এ জন্য গত মঙ্গলবার সংবিধান সংস্কারে ৬২টি প্রস্তাবের মধ্যে উপ-রাষ্ট্রপতি, উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ যুক্তসহ সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদেরও সংশোধন চেয়েছে।

দলটির নেতারা বলছেন, এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বিএনপি আগামী দিনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চায়। রাজনীতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা, ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান রোধ, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের পৃথককরণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে চায়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে ব্যবস্থা করবে দলটি। এসব নিশ্চিতের জন্য উপ-রাষ্ট্রপতি উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ ফিরিয়ে আনা, ফ্লোর ক্রসিংয়ের (নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান বা অন্য দলে যোগদান) মতো ইস্যুগুলোর সংস্কার চেয়েছে।

জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহীদের রক্তের অঙ্গীকার ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যাতে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি না হয়, সেগুলো মাথায় রেখে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে।’

তথ্য বলছে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় উপ-রাষ্ট্রপতি পদ ছিল দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দায়িত্ব নেওয়া বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারে উপ-রাষ্ট্রপতি পদটি যুক্ত করা হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে উপ-রাষ্ট্রপতি পদটি বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে উপ-রাষ্ট্রপতির পদ যুক্ত হলে ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে এই পদটি বাতিল করা হয়। ওই সময় বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। আবার উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সরকারের এবং সংসদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে উপ-প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার কার্যক্রম এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধান করতে পারতেন। এই পদটি ১৫ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে চালু হয়েছিল এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বাতিল করেছিলেন। বিএনপি ওই ক্ষমতায় এসে পদটি আর ফিরিয়ে আনেনি। ইতিবাচক রাজনীতির অংশ হিসেবে বিএনপির সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনায় এ দুটি পদ আবার ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আস্থাভোট, অর্থবিল, বাজেট, প্রতিরক্ষা ছাড়া সব ইস্যুতে সংসদে এমপিদের স্বাধীনতার কথা বলার বিষয়টিও ছাড় দিয়ে বিএনপি সংশোধন চেয়েছে।

এসব বিষয়ে বিএনপিতে আলোচনা হলো, বাংলাদেশে ২০০৮-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক সামনে আসে। ২০০৯ সালে নতুন সরকার গঠনের পর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলকে কেন্দ্র করে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং ওই প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও বেশি গুরুত্ব পায়। বিতর্কের মূল ব্যাপার ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিন তিনটি নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর বাস্তব ক্ষমতা এতটা বাড়ে যে তিনি শুধু রাষ্ট্রের অন্য বিভাগগুলোই নিয়ন্ত্রণ করেন না, বরং রাষ্ট্রের আইনগত প্রধান রাষ্ট্রপতিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটি কমানের জন্য বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজসহ সর্বমহলে আলোচনা প্রাধান্য পায়। আবার সংসদীয় ব্যবস্থায় সংবিধান এমনভাবে প্রণয়ন করা হয় যে, সংসদ নেতা এবং শাসন বিভাগীয় প্রধান একই ব্যক্তি। এর ফলে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে দুটি বিভাগই সাধারণভাবে প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি তার দল থেকে নির্বাচিত হওয়ায় এবং দলে তিনি তার অধস্তন হওয়ায় অথবা রাষ্ট্রপতিকে তার পদে থাকার ক্ষেত্রেও সংসদ নেতার ইচ্ছার ওপর নির্ভর হওয়ায় এবং আদালত কার্যকর স্বাধীন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীই সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একক কর্তা থাকেন। এই সব সাংবিধানিক এবং বাস্তব ক্ষমতাকে বাড়িয়েছে সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে না পারার সাংবিধানিক আইন। ফলে এক প্রকাণ্ড ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী। যাকে চ্যালেঞ্জ করার ন্যূনতম সুযোগ নেই। দলীয় বৃত্তের মধ্যে পড়ে গণতন্ত্রের বিকাশটা যেন বাধাগ্রস্ত বিএনপি সেটি নিশ্চিত করতেই এসব সংস্কার চাচ্ছে বলে দলটির একাধিক নেতা বলছেন।

সংস্কারের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পর্র্যন্ত অভ্যুত্থানে গণতন্ত্রের বিজয়ে মূল বিষয়টাই ছিল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজন। সেটা জাতির সামনে ২৭ দফার মাধ্যমে প্রথম উত্থাপন করেছিল বিএনপি। তার আগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০৩০ ভিশনের মধ্য দিয়ে এটি উত্থাপন করেন। এরপর পতিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আলাপ-আলোচনা করে ২৭ দফাকে ৩১ দফা করেছে। এরমধ্যে কয়েকটি বিষয় আছে যেগুলো আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি গণতান্ত্রিক। খুব বেশি ক্ষমতার ভারসাম্য এখানে রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে দায়বদ্ধতা যেহেতু জনগণের কাছে সেহেতু দলের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে দলের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কোনো যুক্তি নেই। এ কারণে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারটি বিএনপি সংশোধন ও পরিশোধন করতে বলেছে। তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মূল জবাবদিহি থাকে ভোটারদের কাছে, সাধারণ মানুষদের কাছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু বিএনপি বলেছে, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও আন্দোলনরত দলগুলোকে ও দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করব। সেটি গঠন করতে গেলেই ওই সব ব্যক্তিকে সম্মানিত করার ক্ষেত্রে কিছু নতুন নতুন পদ জরুরি হয়ে পড়বে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কিন্তু উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর মতো পদগুলো যুক্ত করা হয়েছে। সবকিছু করা হয়েছে গণতন্ত্রের ভারসাম্য রাখার জন্য। এবং দলীয় বৃত্তের মধ্যে পড়ে গণতন্ত্রের বিকাশটা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেই আকাক্সক্ষা নিয়ে।’