বাংলাদেশ এখন অরাজকতার আগ্নেয়গিরি
আজকাল রিপোর্ট -
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:২৪ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার
অরাজকতার উৎসব চলছে। ষড়যন্ত্রকারিদের উল্লাস। লুটের কোটি কোটি টাকায় অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার উৎখাতের মহড়া। পতিতদের মুচকি হাসি। জুলাই আগষ্ট বিপ্লবীদের অনৈক্যর সানাই। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প ছড়িয়ে ওপাড় থেকে আর্শীবাদ নেবার আকংখা আর কত কি। ব্যর্থ রাষ্ট্র, মেরুদন্ডহীন সরকার রুপায়নে নানামুখি ষড়যন্ত্র চলছে। সেটা চলছে আন্দোলনে সহযোগী গোষ্টীর ভেতর থেকে। পতিত সরকারের ইন্ধনে। সুবিধাভোগী প্রতিবেশি রাষ্ট্র থেকেও। এই অরাজকতার চরিত্রটাই অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। কখনো তা আসছে আনসার আন্দোলন, রিকশাওয়ালাদের আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ইসকন ও হিন্দু-খ্রিষ্টানদের উপর নির্য়াতনের নামে। ১৭টি বছর ফ্যাসিবাদ জনতার কাঁধে চেপেছিল। সভা সমাবেশ করার অধিকার ছিল না। কোন দাবি দাওয়া তুললেই রাজাকার, বিএনপি ও স্বাধীনতা বিরোধীর তকমা লাগিয়ে দেয়া হতো। নির্বাচন ব্যবস্থাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সংসদের অর্ধেকের বেশি এমপি বিনা ভোটে নির্বাচিত, দিনের ভোট রাতে করানোর সংস্কৃতি চালু করেছিলেন।আর কথায় কথায় ক্ষমতার দাপট ও অহমবোধে জনগন নির্বাক হয়ে পড়েছিল। এক ব্যক্তির ইশারায় রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতো। গনতান্ত্রিক রাজনীতির সংস্কৃতি ধ্বংস করেছিলেন শেখ হাসিনা। বিরোধী পক্ষকে গুম আর জেলের নিবাসী করেছিলেন। আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত ব্যবস্থার আয়োজন ছিল ।
জুলাই-আগষ্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান ও বিপ্লব ফ্যাসিবাদের স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দেয়। ১৭ বছরের সাজানো বাগান দুদিনেই শেষ। জনতার কাংখিত একটি অর্ন্তবর্তীকালন সরকার গঠিত হয়। যার নেতৃত্বে আসেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইঊনূস। সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো উপহার ও একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য প্রস্তাব এসেছে রাষ্ট্র কাঠামোর কিছু সংস্কার। তার কাজও চলছে।
১১০ দিন সরকারের বয়স। কিন্তু দাবি দাওয়ার অজুহাতে এই সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। জাতি হিসেবে আমরা ভুলেই গেছি, গোষ্ঠীর দাবিদাওয়া পূরনের প্রাথমিক দায়িত্ব বা মূল কাজ নয় এই সরকারের নয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই জনগনের কাছে দায়বদ্ধ। সাময়িক এই সরকারের প্রধান কাজটি হচ্ছে নির্বাচনের আয়োজন। কিন্তু সাড়ে ৩ মাসের এই সরকারকে ব্যর্থ বানাতে নানামুখি ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ঢাকা শহরকে প্রতিদিন অচল করে দেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। দিবালোকে আইনজীবি হচ্ছেন খুন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিনিষপত্রের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সাধারন মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলতে নানামুখি তৎপরতা। অথচ ১৭টি বছর দাবি দাওয়া নিয়ে একটি মিছিলের অনুমতি পর্যন্ত পাওয়া যেত না। আর করলেই নির্যাতন আর মামলার খড়গ নেমে আসতো।
বাংলাদেশের এই অরাজকতার সন্ধিক্ষনে প্রবাসে বসবাসরত প্রথিতযশা ৪ সাংবাদিকের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চায় সাপ্তাহিক আজকাল। তারা হলেন প্রবীণ সাংবাদিক মনজুর আহমদ, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হাসান ফেরদৌস ও সাহেদ আলম। তারা কি বলছেন? পড়–ন আজকালের পাতায়।
‘ব্যর্থতার দায় সরকারের’
মনজুর আহমদ
হাসিনাকে উৎখাতের কৃতিত্ব কোন রাজনৈতিক দলের নয়। বিরোধী দলের কোন অস্তিত্বই হাসিনা রাখেনি। বিএনপি আর জামায়াত কোনমতে টিকে থাকলেও হামলা-মামলা, খুন, গুম-গ্রেফতারে ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের রাস্তাতেই নামতে দেয়া হয়নি। দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে গঠিত ও রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ পুরো পুলিশবাহিনী শুধু হাসিনার হুকুমই তামিল করেছে। দলীয় এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছে।
এই দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার কৃতিত্ব সর্বাত্মকভাবেই ছাত্র-জনতার। তারাও কোন একক সংগঠন দ্বারা পরিচালিত ছিল না। কোটা সংস্কারের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হাসিনার ভুল পদক্ষেপের কারণে পরিণত হয়েছিল তার পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে। এ আন্দোলন যেমন সংগঠিত ছিল না তেমনি কোন সংগঠন এই আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিল না।
হাসিনার পতনে এখন কোন কোন রাজনৈতিক মহল সাফল্যের আওয়াজ তুলছেন। ইসলাম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তারা বোধহয় ধরেই নিয়েছেন দেশে তাদের শাসন কায়েম হয়ে গেছে। তাদের এমন সব কর্মকান্ডের খবর পাচ্ছি বা ভিডিও দেখছি যেগুলিকে রীতিমত অরাজকতা বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে দেখা যাচ্ছে। ‘ইসকন’ নামে একটি হিন্দু ধর্মান্ধ মহল তো দেখছি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তারা কোন রাজনৈতিক দলের নন। কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা যেমন তাদের নেই তেমনি কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থনেও তারা শক্তিশালী নন। তাদের দেশ চালাতে হচ্ছে হাসিনার সেই আওয়ামী ক্যাডারদের দিয়ে গঠন করা প্রশাসন দিয়ে। সব কিছুই এখনও তাদের প্রতিকূলে।
একটি অরাজনৈতিক অস্থায়ী সরকারের কাছে জনগণের খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা থাকতে পারে না। এই সরকার কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার করতে চায়। এই সংস্কারগুলি নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষ এই সংস্কারের দিকে তাকিয়ে আছে। সংস্কারের পর নির্বাচন দিয়ে এই সরকার তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব শেষ করবে।
কিন্তু তার আগে যারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাবে, তারা যেই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কোনরকমের দুর্বলতা তাদের ব্যর্থতারই পরিচয় বহন করবে।
‘সরকার পক্ষই দায়ি’
সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ
প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু কিছু ঘটনা যাকে কেউ কেউ অরাজক পরিস্থিতি বলে অভিহিত করেছেন সেবিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর থেকেই বহুমুখি বক্তব্য আসছে। একজন বলেছেন বাম ও ডানপন্থীরা এসবের জন্য দায়ী। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আগষ্ট বিপ্লবের সহযোগিদের একাংশ অসন্তুষ্ট হয়ে নাশকতা করছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক সারজিস আলম বলছেন, পতিত সরকারের লোকজন পরিস্থিতি অশান্ত করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য/মন্তব্য দ্বারা বর্তমান ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই একটা ধোঁয়াসা সৃষ্টি করেছেন।
অপরদিকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এখন অতীব নাজুক অবস্থা। তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই। এই দলের বেশ কিছু লোক নিহত হয়েছেন, সম্ভবত বহু হাজারকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে এই দলের সবাই সরকারের কঠোর বিরূপ দৃষ্টিতে রয়েছেন তাই আওয়ামী লীগের দ্বারা এখন দেশে নাশকতা করা তো দূরের কথা কোন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আয়োজনও অসম্ভব। তাই তাদের ওপর দোষ চাপানো নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দেয়ার নামান্তর। বরং বাম ও পন্থীরা এবং কাঙ্খিত সুযোগ বা গুরুত্ব না পাওয়ার ক্ষোভজনিত কারণে আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ এসব ঘটাচ্ছে বলে মাহফুজ আলম এর বক্তব্য বিশেষ তাতপর্যপূর্ণ ও অধিকতর প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।
সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ্ বলেন, পর্দার অন্তরালে বা আধাঅন্তরালে নানামুখী খেলা চলছে বলে ধারণা করার নানাবিধ ঈঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গোলাম মাওলা রনি, পিনাকী ভট্টাচার্য সহ বিভিন্ন টকশো ওয়ালাদের বক্তব্য শুনলে এমনধারা ঈঙ্গিত স্পষ্টতর হয়। যেমন পিনাকী বিদায়ী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন। কিন্তু অন্তরবর্তী সরকারের আমলেও তার বক্তব্য রহস্যজনক ও বিভ্রান্তিকর। তার অনুসারীরাই এই সরকার বিরোধী অনেক কর্মকান্ডে জড়িত এমন দাবি তিনি করেছেন বলে দেশের একটি টিভিতে বলা হয়েছে। এই সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের ভূমিকা রহস্যময়। এমনধারা রহস্যমানুষদের কেউ কেউ কোন বিদেশি শক্তির স্বার্থে তাদের এজেন্ট হিসেবে, এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার অপকর্মে লিপ্ত বলেও সন্দেহ করার অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক বা বিস্তার লাভ করুক তা দেশপ্রেমিক কারোরই কাম্য নয়। আবার বিগত সরকারের লোকজনের ও সমর্থকদের কথিত অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নামে পাইকারি হারে গ্রেফতার, মামলা ও নির্মূল অভিযান সমাজ ও রাষ্ট্রের দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি সাধনে ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে বাধ্য। তাছাড়া পতিত সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের নামে একাত্তরের শত্রুদের পুনর্বাসন ও তাদের ক্ষমতারোহণের আয়োজন, একাত্তরের আদর্শে বিশ্বাসীদের খতম, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সকল প্রতীক, চিহ্ন ও স্থাপনা ধ্বংস ইত্যাকার পদক্ষেপ অশুভ ও অকল্যাণের বার্তাবহ এবং অবশ্যই এই সরকারের 'গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার' ঘোষিত লক্ষ্যের পরিপন্থী।
মোদ্দা কথায়, এমন ধারণা করার সঙ্গত ভিত্তি রয়েছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের পরস্পরবিরোধী পক্ষগুলির ও তাদের ক্ষমতারোহণের জনান্তিকের কুশীলবদের মধ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, এই সরকারের বিবিধ অবিমিশ্রকারী পদক্ষেপ এবং 'আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন' বনাম 'আগে নির্বাচন পরে সংস্কার' এই দুই পক্ষের মধ্যে রশি টানাটানি ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশ এই 'অরাজকতা'।
‘ভারতে বসে হাসিনার ষড়যন্ত্র’
হাসান ফেরদৌস
হঠাৎ যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ৫ অগাস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আমি সে পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। প্রায় দুই দশকের স্বৈরাচার যখন আমাদেও সকল শুভবোধ ও সম্ভাবনার আশাকে গলা টিপে ধরেছে, সেই সময় এই অভ্যুত্থানকে হটাৎ আলোর ঝলকানি মনে হয়েছিল। রাতারাতি সব বদলে যাবে এমন নির্বোধের মত কোন চিন্তা আমার মাথায় ছিল না। কিন্তু অবস্থা যে এত দ্রুত এত সর্বনেশে হয়ে উঠবে তাও আমি ভাবিনি।
সব বিপ্লবের পরেই প্রতি-বিপ্লব হয়, এতটুকু ইতিহাস আমার জানা আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর তার প্রথম পাঁচ বছর যে বিশৃঙ্খলা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দ্রুত বিস্তার ঘটে তাতো আমাদের অনেকের চোখে দেখা। তাঁর নিজের দলের ভেতরেই যে অপরাধী ঘাপটি মেরে বসে, তা দেখে সক্ষেদে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, চারপাশে সব চাটার দল।
বাংলাদেশের চলতি অস্থিরতা ও বিশৃংখলার কয়েকটি দৃশ্যমান কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিপ্লবের পর মানুষ ভেবেছে অবস্থা দ্রুত বদলাবে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় হয়ে আসবে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আসেনি, তার একটি কারণ অস্থায়ী সরকারের অদক্ষতা। অন্য কারণ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমুহ পুরোপুরি স্বাগত জানায়নি। বিগত সরকার নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার ‘বীমা’ হিসাবে প্রতিটি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে তাদের অতি-অনুগত ক্রীড়নক বাহিনীতে পরিণত করেছিল। স্বৈরাচার পতনের তিন মাস কেটে গেছে। কিন্তু বিগত প্রশাসনের প্রতি আনুগত্য এতদিনেও তারা ঝেড়ে ফেলতেপারেনি। সন্দেহ করি, এই বাহিনীর কোন কোন অংশ ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবকে পরাজিত দেখতে চায়।
দ্বিতীয়ত, বহিষ্কৃত সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাচ্যুত হলেও তাদের কেউ কেউ দেশের ভেতরে-দেশের বাইরে থেকে পালটা কামড় দেবার জন্য সুযোগ খুঁজছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতের মাটিতে বসে খোলামেলাভাবেই ষড়যন্ত্র করে চলেছেন। দেশের অভ্যন্তরে যত বিশৃংখলা বিস্তৃত হবে, সেই ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে।
তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় বড় রকমের ইন্ধন জোগাচ্ছে ভারত। সে দেশের ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক মিডিয়া খোলামেলাভাবেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেবসেছে। আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত হামলা সেই যুদ্ধ ঘোষণায় সহায়তা করছে তাতে সন্দেহ নেই। ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়ে বসেছে, ইউনুস সরকারের আয়ু শেষ হবার পথে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়রা সদ্য নির্বাচনে জয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বারস্থ হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আর্জিনিয়ে।
এই চক্রান্তের কোনটাই কাজে লাগবে না যদি চলতি সরকার তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দ্রুত ও যোগ্যতার সঙ্গে সমাধানে সক্ষম হয়। ৫ আগস্টের সফল অভ্যুত্থানের পর জনগণের কাছ থেকে তারা একটাই ম্যান্ডেট পেয়েছেনঃ যত দ্রুত সম্ভব নির্দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন সমাধা করা। কিš ‘সে পথে দ্রুত এগুনোর বদলে তারা পুরো দেশ ও তার শাসনযন্ত্রকে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলেনিয়েছেন।
১৫-২০ বছরের জঞ্জাল রাতারাতি উবে যাবে না, একথা আমরা খুব ভাল করেই জানতাম। যে অনভিজ্ঞ কিন্তু উচ্চাভিলাষী অরাজনৈতিক গ্রুপটি এখন ক্ষমতার কেন্দ্রে, তাদের উদ্দেশ্যের সততা নিয়েও আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রশাসন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রশাসনিক কর্মযোগ। যারা সেই কর্মযোগের কান্ডারি, তাদের বোঝা উচিত কী করা উচিত, কতোটা করা উচিত, এবং কখন তাদের থামতে হবে।
এখনও সব শেষ হয়নি। আলো নিভে আসার আগেই এই সরকারের উচিত হবে আগামী নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি শুরু করা।
‘পতিতদের স্বপ্নদোষ’
সাহেদ আলম
বাংলাদেশে বর্তমান অস্থিরতা বিরাজ করছে তা এক ধরনের কৃত্রিম বলে মনে করি। ন্যাচারাল একটি অস্থিরতা থাকতেই পারে। ১৮ কোটি মানুষের একটা দেশ । সব সময় কিছু না কিছু একটা থাকবে। এমনতো নয় ৫ আগষ্টের আগে কোন অস্থিরতা ছিল না। সবসময়ই একটা অস্থিরতা ছিল। তখন মানুষ যতনা প্রকাশ করতে পারতো । সংবাদপত্রের ন্যারেটিভ- বিষয়গুলো এমনভাবে তুলে ধরা হতো দেশে কোন সমস্যাই নাই। এখন যেহেতেু গণমাধ্যম উন্মুক্ত। কোথাও কিছু হলে টের পাচ্ছি।সবাই যার যার মতো করে একটা মতামত দেবার চেষ্টা করছি। দশচক্রে একটা ভগবান ভুত হবার মতো একটা অবস্থা।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। ব্যক্তি বিশেষ গোষ্ঠীর যায়গা থেকে এ অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা তৈরি করতে বড় কিছু লাগে না। ধরুন, একটা গোষ্ঠী ৫০ জনকে দিয়ে হাউকাউ করিয়ে ট্রেনে ইট ছুড়তে ব্যবস্থা করলেন। তাদেকে আলাদা করে পয়সা দিলেন। তারা সেটা করবে। এটাও একটা অস্থিরতা। আসলে মানুষের সৃষ্ট অস্থিরতা আমরা দেখছি। আর সেটা হচ্ছে বিশেষ গোষ্ঠী থেকে। এটা সত্য- পতিত ও খুনী সরকারের এতে একটা ইন্ধন আছে।অবৈধ পথে অর্জন করা তাদের বিলিয়ন অব ডলারস পড়ে আছে। তারা তা এখন কাজে লাগাচ্ছে। মতাদর্শের একটা লড়াই আছে। যে পরাজয়টা তাদের হয়েছে, সেটাকে কোনভাবেই তারা মেনে নিতে পারছে না। তাদের ধারণা, আনস্টেবল করতে পারলে হয়তো তারা ক্ষমতায় আসবে।এটা তাদের একটা স্বপ্নদোষ বলে মনে করি। কোনদিনই সম্ভব না। যত অস্থিরতাই থাকুক, বাংলাদেশের মানুষ পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।
কিন্তু ভেতর থেকেও একটি মহল মিডিয়া ও সোশাল মিডিয়ায় নানা প্রচারণা দিচ্ছে। বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র। তারা সেটা বদলে দিতে চায়। দেশের চরিত্রটাকে পাল্টে দিয়ে তারা ইসলামী রেভ্যুলেশন তারা চায়। তারা প্রকাশ্যে বলছে, তাদের বিপ্লব শেষ হয়নি। এটা করতে গিয়ে তারা ছাত্রদের বিপক্ষে কথা বলছে। পরিষ্কার তাদের এজেন্ডা- বাংলাদেশে একটি ইসলামিক ধারার সরকার তৈরি করা। আর এটা করতে গেলে একটা অস্থিরতা লাগবে। আর এটা হলে হয়তো তারা ভাবছে সেনা বাহিনী ক্ষমতা গ্রহন করবে। তখন হয়তো তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ঐ সরকার গঠন করবে। কিংবা সেনাবহিনী দিয়েই তারা একটি রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলাবে। ননইনক্লুসিভ একটি সরকার গঠন করতে পারবে। এটাই তাদের স্বপ্ন। এটার পেছনে ৩ বা ৪ জনের হাত রয়েছে। এটার জন্য সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে একটা দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা। আবার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মারামারি লাগানোতে ইন্ধন দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই অরাজকতার বিরুদ্ধে। আশার কথা হচ্ছে, বৃহৎ রাজনৈতিক দল সরকারের সাথে দেখা করেছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামিও এই সুরেই কথা বলছে। কিন্তু মাঠে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে লোকও রয়েছে। পতিত সরকারও ইউনূস সরকারকে দুর্বল ভেবে উৎখাত করতে চায়। আমি আশাবাদী এ সব ষড়যন্ত্র পরাজিত হবে।