ইসকন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লি টানাপোড়েন
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৪৪ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস নামের একজন পুরোহিতকে গ্রেফতারের পর উত্তাপ ছড়ায়। চট্টগ্রামে সৃষ্ট উত্তাপ ঢাকা থেকে দিল্লি পর্যন্ত গড়ায়। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা-দিল্লি রীতিমত টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের পত্রিকাগুলোর লিড নিউজ এখন বাংলাদেশ। উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। তার ফলে দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রামের এই ধর্মীয় নেতাকে গ্রেফতারের জের ধরে তার অনুসারীরা রাস্তায় নেমে আসেন। আদালত তার জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে অনুসারীরা রাস্তায় শুয়ে প্রিজন ভ্যান আটকে দেয়। তাদের সরাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে টিয়ার সেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে হয়। চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে হানাহানি। সহিংসতায় প্রাণ হারান চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবি সাইফুল ইসলাম আলিফ।
আলিফ হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন আদালতসহ গোটা বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণ ভাবনা সংস্থা ইসকন নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতে লংকাকান্ড ঘটে চলেছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার দাবি জানিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। সংখ্যালঘূদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। উগ্রহিন্দু গোষ্ঠীগুলো ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনসমূহে ঘেরাও করছে। কথা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গেুর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় দাঁড়িয়ে মমতা বলেন, হিংসা ও ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে তিনি দুঃখিত। তবে বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে সুরাহা হতে হবে।
এই ঘটনায় হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে ইসকনের নাম। ইসকন নিষিদ্ধ করার দাবি উঠতে থাকে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের সঙ্গে ইসকন নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আসছে কেন এই প্রশ্নে জানা গেল, চিন্ময় একদা ইসকনের পুরোহিত ছিলেন। ইসকনের অভ্যন্তরীণ কারণে চিন্ময়কে বহিস্কার করা হয় কয়েক মাস আগে। তারপর তিনি সনাতনী জাগরণ জোটের নেতা হয়ে ওঠেন। বয়সে তরুণ এই পুরোহিত হিন্দু তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার বক্তব্য শোনার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন। তিনি সংখ্যালঘূ সম্প্রদায়ের আট দফা দাবির পক্ষে এক ধরনের উন্মাদনার সৃষ্টি করেন। চিন্ময়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপরে গেরুয়া পতাকা টাঙ্গিয়েছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ।
একটা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প, একটা ঘৃণার আবহ বাংলাদেশের ভেতওে প্রচন্ডভাবে আনার প্রচেষ্টা লক্ষ্যনীয়। এই প্রচেষ্টার পেছনে মহল বিশেষ থাকতে পারে। যারা বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে ফায়দা লুটতে চান; তাদের এই প্রচেষ্টায় ঘি ঢালছে ভারতীয় কতিপয় মিডিয়া। তারা বাস্তবতা বিবর্জিত, অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ দিনের যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য; তার মূলে আঘাত করে ঘৃণ্য কায়েমী স্বার্থের রশি টেনে দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে দৃশ্যত টানাপোড়েন সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের আগে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা পরস্পরকে মুখোমুখি করে দিয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খুবই ভাল সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। ওই সময়টাকে বলা হয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সোনালী অধ্যায়। শেখ হাসিনার পতনের পর পরই কতিপয় ব্যক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংখ্যালঘূদের ওপর হামলার ঘটনা থাকলেও সংখ্যালঘূদের আট দফা দাবি নতুন ঘটনার জন্ম দেয়। অনেকেই মনে করছেন, শেখ হাসিনা কিংবা ভারতের ইন্ধন থাকার কারণে সংখ্যালঘূ আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। এমন ধরনের সন্দেহ-অবিশ^াস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির লক্ষ্যে করা হতে পারে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক অনেকটা অনিশ্চিত গন্তব্যে অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি অভিন্ন স্থল সীমান্ত রয়েছে। এছাড়াও, সমুদ্রসীমা আছে দুই দেশের মধ্যে। বড় ধরনের বাণিজ্য আছে প্রতিবেশি দুই দেশের মধ্যে। কানেকটিভিটি ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বিদ্যমান দুই প্রতিবেশির মধ্যে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ার পর সম্পর্কের সেই গতি ধরে রাখাও চ্যালেঞ্জ।
ইসকন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয়ের পর ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে সম্পর্কের ধরনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্ন্তবর্তি সরকার চাপে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। তার ওপর নতুন করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।