রোববার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৬ ১৪৩১   ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুবলারচরে ‘সাহেবদের’ রাজত্ব

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৬ এএম, ১ ডিসেম্বর ২০২৪ রোববার

  • ‘পাস’ দেওয়ার নামে টাকা আদায় করা হয়
  • ৫ মাসের সংগ্রামী জীবন শেষে ফের বেকার
  •  তেলসংকটে বন্ধ থাকে মোবাইল টাওয়ার

 

 

আবদুর রাজ্জাক প্রায় ২০ বছর ধরে মাছ ধরা ও শুঁটকি বানানোর কাজ করেন সুন্দরবনের দুবলারচরে; প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত থাকেন সেখানে। বাকি সময় কাটান পরিবারের সঙ্গে সাতক্ষীরায়। দুবলারচরে যেতে বিশেষ ‘পাস’ নিতে হয় তাদের। আর ‘সাহেব চক্র’কে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও নিতে হয়। টাকা না দিলে পাস মেলে না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও সাহেবদের রাজত্ব কমেনি।

রাজ্জাকের মতো প্রায় ১০ হাজার মৎস্যজীবী জিম্মি ‘সাহেবদের’ কাছে। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে। দুবলারচরে একটি মাত্র বাজার থাকলেও, সেখানে নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা। তেলের অভাবে প্রায়ই বন্ধ থাকে একমাত্র মোবাইল টাওয়ারটি। দুবলারচরের মৎস্যজীবীরা ভালো নেই। পাঁচ মাসের সংগ্রামী এক জীবন তাদের। তবু বাঁচার চেষ্টা করছেন তারা। সম্প্রতি সুন্দরবনে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে আরও অনেক তথ্য।

কথা আছে, জেলেরা মোবাইল ফোনেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাঁচা মাছ ও শুঁটকির দর ঠিক করতে পারেন। সুন্দরবনে টেলিটক নেটওয়ার্কের গুরুত্ব অনেক বেশি হলেও প্রায়ই নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় জেলেদের। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় নেটওয়ার্ক। তখনই বিপাকে পড়েন জেলেরা। তখন মাছের যথাযথ দর ঠিক করতে না পেরে কম দরেই সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, শুঁটকির মৌসুম কেন্দ্র করে দুবলারচর সরগরম হয়ে উঠেছে। মাছ আহরণ শেষে সেসব রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও শুঁটকি পাঠানো হয়।

চলতি বছর শুঁটকি মাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। গত বছর শুঁটকি হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার টন। বঙ্গোপসাগরের দুবলারচর, মেহের আলী, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলারচর, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, চাপড়াখালী, কোকিলমনি ও হলদাখালীর চরে জেলেরা শুঁটকি তৈরি শুরু করেছেন। বন বিভাগ থেকে তাদের পাস-পারমিট দেওয়া হয়েছে।

মোংলা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে দুবলারচরে মাছ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের জন্য ১৩টি কেন্দ্র রয়েছে। মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ ও বিক্রির জন্য মৎস্যজীবী এবং ডিপোর মালিকরা সেখানে যান। এ বছর ৯৮৫টি বাড়ি, ৫৭টি ডিপো ও ৯৩টি দোকান স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। এসব ঘর বা ডিপোতে ওঠা প্রতি কুইন্টাল রূপচাঁদা ও লাক্ষা মাছের শুঁটকি থেকে ১৫০০ টাকা এবং অন্য সাধারণ মাছের শুঁটকি থেকে প্রতি কুইন্টালে ৫০০ টাকা রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। জেলেরা সাধারণত লইট্টা, ছুরি, খলিসা, ভেদা, চিংড়ি, ইচা ও রূপচাঁদা মাছ আহরণ করেন। তবে জেলেদের জন্য যে পরিমাণ সুবিধা থাকার কথা, তা নেই। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও ‘সাহেবদের’ স্বভাব বদলায়নি। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুরো দুবলারচর।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, দুবলারচরের শুঁটকিপল্লী ১৪ সাহেবের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে মেজর জিয়া উদ্দিন আহমেদ তার ছোটভাই কামাল উদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শাহানুর রহমান শামীম ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের দুবলারচরে। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুঁটকি মাছের ব্যবসা শুরু করেন তারা।

সর্বশেষ মর্তুজা বাহিনীর সদস্যরা পূর্ব সুন্দরবনের হারবাড়িয়া ও মেহেরালীরচর এলাকার মাঝামাঝি চরপুঁটিয়ায় মেজর জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বন্দুকযুদ্ধে মর্তুজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর দুবলারচরসহ পুরো সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ নেন কামাল উদ্দিন।

চরের মৎস্যজীবীরা বলেছেন, আফিয়া বেগম, খান শাফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এ বি এম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুন নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমান সরদার ‘সাহেব’ হিসেবে পরিচিত। তারা জেলেদের জন্য ‘পাস’-এর ব্যবস্থা করেন।

শুঁটকি পল্লী হিসেবে খ্যাত দুবলারচর এখনো সিন্ডিকেটমুক্ত হয়নি। বিভিন্ন জলদস্যু বাহিনীর প্রধানরা আত্মসমর্পণ করলেও সাহেবরা এখনো সক্রিয় আছেন। তারা জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছেন। জেলেরা চাঁদা দিলেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। সাগর থেকে মাছ ধরে পল্লীতে নিয়ে আসার পর তাদের কাছেই বিক্রি করতে বাধ্য হন জেলেরা।

জেলেদের অভিযোগ, প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করেই মহারথীরা চলেন। দাদন, জেলেদের নিয়ন্ত্রণ, কাঁচা মাছ ও শুঁটকিপল্লী নিয়ন্ত্রণ, সাইক্লোন সেন্টারগুলোর নিয়ন্ত্রণ সবই করেন সাহেবরা। জেলেদের কাছে শুধু টিকিট বিক্রি করেই তারা পাঁচ মাসে অন্তত ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন।

সুন্দরবনের দক্ষিণে পশুর নদীর পূর্বদিকে দুবলারচর। আলোরকোল, খেজুরতলা, জামতলা, মাঝেরকেল্লা, অফিসকেল্লা, সেলারচর ও নারকেলবাড়িয়া প্রত্যেকটি আলাদা চর। সব কটি মিলেই দুবলারচর। সবচেয়ে বড় চর হলো আলোরকোল। প্রতিবছর শতকোটি টাকার কাঁচা মাছ ও শুঁটকি বিক্রি হয়। এ টাকার সিংহভাগই নিয়ন্ত্রকদের কাছে চলে যায়। বন বিভাগ থেকে লিজ নেওয়ার পরও সাহেবদের মাছ ধরার টিকিট বাবদ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা নিতে হয় জেলেদের। রিনিউ করার নামে নেওয়া হয় জনপ্রতি ৭০০ টাকা।

প্রতিবছর জেলেরা সুন্দরবনের দুবলারচরসহ পাঁচটি চরে মাছ আহরণে যান। প্রত্যেক জেলে দাদন বা ঋণ নেন। প্রথমে তারা ব্যবসায়ীদের ৩ লাখ টাকা করে দেন। এরপর ওই ব্যবসায়ী আরও টাকা চাইলে তা সুদ হিসেবে দেওয়া হয়। পাঁচ মাসে প্রতি লাখে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা সুদ নেওয়া হয়। দুর্যোগ বা কোনো কারণে টাকা দিতে বিলম্ব হলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, জেলেদের ঋণ, ঋণের সুদ কত হবে, দাদন কে দেবেন- এসবও নিয়ন্ত্রণ করেন সাহেবরা। তাদের ওপরে কেউ কথা বলতে পারেন না।

রূপচাঁদা, লইট্টা, ছুরি, খলিসাসহ ৮৫ প্রজাতির মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি সুন্দরবনে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ সেখানে বছরে পাঁচ মাস কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ পাঁচ মাসের আয়-রোজগারের টাকায় চলে তাদের সারা বছর। পাঁচ মাসে জেলেরা দু-এক মাস পর চার-সাত দিনের জন্য ছুটিতে বাড়িতে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান।

বাগেরহাটের রামপালের ইমরান ফরাজী জানান, তার বাবা কুদ্দুস ফরাজী ৫০ বছর আগে এ চরে শুঁটকির ব্যবসা করেছেন। তার অন্য ভাই মুতাচ্ছিন ফরাজীও এ ব্যবসায় জড়িত। এ খাত থেকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পেলেও নেই পৃষ্ঠপোষকতা। সাহেবরা বন বিভাগ থেকে তাদের মাছ ধরার অনুমতির ব্যবস্থা করে থাকেন। তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন জেলে-মহাজনদের কাছে। কামাল উদ্দিন, খুলনার পিন্টু কমিশনার, খোকন, হক, হাকিম বিশ্বাস ও জাহিদুল সাহেব সেখানে বিনিয়োগ করেন। সাহেবরা বিনিয়োগ করলেও সে টাকা পর্যাপ্ত না হওয়ায় মহাজনরা এনজিও থেকে শতকরা ১৪ টাকা সুদহারে লাখ টাকা ঋণ নেন। র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড তদারকি করে। তারপরও সাহেব ও তার লোকজন সক্রিয় আছেন।

মাছ শুকানোর কাজে নিয়োজিত লোকমান হোসেন জানান, একটি নৌকা তৈরিতে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা লাগে। যারা মাছ ধরেন, তারা মাসে ১০ হাজার এবং যারা শুকান, তারা মাসে ৫ হাজার টাকা করে পান। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন মহাজন।

জেলে রতন মণ্ডল জানান, তার বাড়ি বাগেরহাটের রামপালে। চরে বড় বাজার আছে, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেটি খোলা থাকে। সেখানে নিত্যই পণ্য বিক্রি হয়। সাড়ে ৩ হাজার ঘরে ৪০-৫০ হাজার মানুষ থাকেন এবং কাজ করেন। রাতে সৌরবিদ্যুতের আলো তাদের ভরসা। মহাজন ছাড়া কেউ কোনো শুঁটকি বিক্রি করেন না। এখানে কোনো নারীশ্রমিক নেই। এখানে শুঁটকির নিজস্ব বাজার রয়েছে। অনেক শুঁটকি বিদেশেও রপ্তানি হয়। পর্যটকরা গেলে তাদের কাছে শুঁটকি মাছ বিক্রি করা হয়। কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাগুন ও চৈত্র মাস মিলে দুবলারচরে কাজ চললেও ঘর ও মাচা নির্মাণে অনেকটা সময় চলে যায়।

তিনি বলেন, সূর্যোদয়ের আগেই তারা মাছগুলো জাল থেকে বের করেন এবং শুঁটকি বানাতে রোদে শুকাতে দেন। সাতক্ষীরা, খুলনা, পিরোজপুর, বরগুনা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার জেলে মাছ শুকানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য এখানে অস্থায়ী ঘর তৈরি করেন। অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় বেশি মাছ পাওয়া যায়। শুঁটকিগুলো সরাসরি কুয়াকাটা, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো হয়।