রোববার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৬ ১৪৩১   ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সংকটে ৪৬০ থানা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৪ এএম, ১ ডিসেম্বর ২০২৪ রোববার

নানা সংকটে জর্জরিত পুলিশ। গত ৫ আগস্টের আগে ও পরে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা এবং অবকাঠামোয় হামলার ক্ষত এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে পুলিশ সদস্যদের। বিপরীতে এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। মাঝেমধ্যেই ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। বেড়েছে চুরি-ডাকাতি ছিনতাইসহ বহুমাত্রিক অপরাধ। এখনো অনিরাপদ সড়ক-মহাসড়ক, শহর-জনপদ। যৌথ বাহিনীর সহায়তা ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিতে এখনো শতভাগ ভূমিকা রাখতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। স্বাভাবিক  হয়নি এখনো পুলিশের দাপ্তরিক কার্যক্রম।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থানাসহ নানা স্থাপনায় ব্যাপক লুটপাট হয়। অস্ত্র-গুলি, মামলার নথিসহ কোটি কোটি টাকার মালামালের হদিস এখনো মেলেনি। সহিংস হামলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ১২০টি থানায়। এর মধ্যে ৫৮টি থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুরের শিকার হয়েছে ৬২টি থানা। ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১৪টি। ১ হাজার ৭৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলা থেকে রেহাই পায়নি পুলিশ সদর দপ্তরও। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত হবে স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বরত ফোর্সকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলে গিয়ে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের সহায়তা নেওয়া। প্রয়োজনে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সহায়তা নিতে পারেন তারা। ওই সময় প্রয়োজনে যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রাখা যেতে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার বিকল্প নেই। নয়তো সমাজে স্থিতিশীলতা আসবে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, পুলিশের সবকিছু ভেঙে পড়েছে। পুলিশে মিলিটারাইজেশনের ফলে কী ক্ষতি হয়েছে, সেটা সবাই দেখছেন। এখন পুলিশে মিলিটারি ব্রেন ঢুকে পড়েছে। এ জন্য পুলিশে সংস্কার জরুরি। পলিটিক্যাল ভিশন না থাকলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না। তা ছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড়সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজন হবে না।

তবে নবনিযুক্ত আইজিপি বাহারুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি আমার কাজ শুরু করেছি। যদিও এটি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবু শিগগিরই একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবেন।’

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ৫ আগস্ট পূর্বাপর ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার হামলায় ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন। এ ছাড়া হামলায় পুলিশের অনেক সদস্য আহত হন। যাঁদের মধ্যে ৫০৭ জন রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এ কারণে কাজ করতে খুব সমস্যা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে বেশির ভাগ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতায় ৫০টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ৫ ও ৬ আগস্ট ২১টি থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে যায় ১৩টি থানা। লুট করা হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এর মধ্যে কিছু উদ্ধার হয়েছে।

তবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মব কন্ট্রোলে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। আগাম সংবাদ পাওয়ার পরও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে সক্ষম হচ্ছে না, এমন অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। এর মধ্যে গত বুধবার হবিগঞ্জের আজমীরিগঞ্জের নোয়াগড় গ্রামে টানা দেড় ঘণ্টা দুই পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ সদস্যরা ভয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। আগে থেকেই বিষয়টি জেলা পুলিশ অবহিত হলেও সেই সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সবশেষ যৌথ বাহিনীর সহায়তায় দেড় ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। যদিও সেই গ্রামে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে।

ডিএমপির ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো হলো, উত্তরা পূর্ব থানা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পল্টন, শেরেবাংলা নগর, শ্যামপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ভাটারা, ওয়ারী ও খিলক্ষেত। অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি এসব থানায় চালানো হয় ব্যাপক লুটপাট। সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত এসব থানার নিয়মিত কার্যক্রম (নাগরিক সেবা) পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কোনোরকম চেয়ার-টেবিল পেতে প্রতিদিনের কাজ চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এই বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আবারও স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফেরার চেষ্টা করছে পুলিশ।

ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৫ ও ৬ আগস্ট ডিএমপির ২১টি থানায় হামলা এবং ১৩টি থানায় অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুট করা হয়েছে অস্ত্র। এসব থানার মামলার নথিপত্র, পোশাক, গাড়ি ধ্বংসের পাশপাশি হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে চার মাস পার হতে চললেও এখনো এসব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক করা যায়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পূর্ব থানা, ভাটারা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাড্ডা, শ্যামপুর, খিলগাঁও, আদাবর, পল্টন, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ওয়ারী ও খিলক্ষেত থানার। অন্য থানাগুলোরও যে ক্ষতি হয়েছে তা-ও এখনো পূরণ করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো এসব থানায় স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরেনি। তবে থানাগুলোতে মেরামতকাজ চলছে। আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা চলছে।

অবসরে যাওয়া সাবেক ডিআইজি শেখ সাজ্জাত আলীকে চুক্তিভিত্তিক ডিএমপি কমিশনার করে অন্তবর্তী সরকার ডিএমপির সদস্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনার সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে তাদের সহায়তা চেয়েছেন। রাজধানীতে ৫০ বছর ধরে চলা চাঁদাবাজি বন্ধে নিজের প্রত্যয়ের কথাও বলেছেন সম্প্রতি একটি বৈঠকে। একই সঙ্গে পুলিশকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি।

জানা গেছে, মিরপুর, বাড্ডা, আদাবর, ওয়ারী এবং শ্যামপুর ও শেরেবাংলা নগর থানার মামলার আলামত পুড়ে গেছে। হামলায় ক্ষতি হওয়া ভাটারা থানা সংস্কার করে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। ভাটারা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আদাবর, পল্টন ও ওয়ারী থানায় ১ হাজার ২২৬টি মামলার নথিপত্র পুড়ে যাওয়ার তালিকা করা হয়েছে। বাকি থানাগুলোতে কী পরিমাণে মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে তার তালিকা এখনো তৈরি করা হয়নি।

ভাটারা, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, খিলক্ষেত ও খিলগাঁও থানার ওসিরা জানিয়েছেন, এই থানাগুলোতে লুট হওয়া, পুড়ে যাওয়া কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত মামলার নথিপত্রের হিসাব করা হচ্ছে। আতঙ্ক কাটিয়ে তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছেন।

সরেজমিন রাজধানীর আদাবর থানায় দেখা গেছে, ওই থানার চারটি গাড়ি, ২০টি মোটরসাইকেল, ৩০টি ল্যাপটপ ও কম্পিউটার, ৫টি এসি, টিভি, কক্ষের দরজা, ফ্যান, ফ্লোরের কার্পেটসহ অন্যান্য আসবাবে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগের ফলে ভবনের অবকাঠামো ঝলসে গেছে। ওই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখনো বর্তমান থানার ভিতরে-বাইরে। গতকাল দুপুরে সরেজমিন এমন চিত্র দেখা যায়। মিরপুর মডেল থানার পুলিশ জানিয়েছে, থানায় ৬৬০টি মামলার নথিপত্র এবং মালখানায় থাকা বিভিন্ন মামলার ২৩০টি আলামত পুড়ে গেছে। থানা ভবনে থাকা নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতাও পুড়ে গেছে। বিভিন্ন মামলার কেস ডকেট বা সিডি (সব নথিপত্র) পুড়ে গেছে।

আগুনে মোহাম্মদপুর থানার ৮৯টি মামলার নথি পুড়ে গেছে। তবে কতগুলো মামলার আলামত ছিল, তা জানাতে পারেনি পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার আহমেদ বলেন, থানার সব নিবন্ধনখাতা পুড়ে যাওয়ায় কতগুলো মামলার আলামত লুট হয়েছে বা পুড়ে গেছে বা ধ্বংস হয়েছে, সেই সংখ্যা এখনো জানা যায়নি।

শেরেবাংলা নগর থানায় মামলার সব নথিপত্র এবং দেড় শর মতো আলামত পুড়ে গেছে। ওয়ারী থানার ৭৪টি মামলার নথি এবং ২১৫টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে ও লুট হয়েছে। শ্যামপুর থানায় পুড়ে গেছে বা লুট হয়েছে ২৩৯টি মামলার আলামত। বাড্ডা থানায় পুড়ে গেছে ১৩৭টি মামলার নথি ও ১৬০টি মামলার আলামত।