সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৮ ১৪৩১   ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কঃ তালি বাজাতে দুই হাত লাগে

হাসান ফেরদৌস

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:০৭ এএম, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ শনিবার

মন্তব্য প্রতিবেদন

 

 

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে মারাত্মক রকম অবনতি ঘটেছে। অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে আমরা একে অপরের পতাকা অবমাননার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। ঢাকায় সাড়ম্বরে ভারতের পতাকা পদদলিত করা হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশি পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে পোড়ানো হয়েছে। ভারতে অতি উৎসাহী এক বা একাধিক ব্যক্তি বাংলাদেশের পতাকার আদলে শৌচাগারের পাপোশ বানিয়ে বিক্রিরও প্রস্তা¦ দিয়েছে।
একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণের এই প্রতিযোগিতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় দুই দেশের সম্পর্কে যে ক্ষতি হবে তা সহজে পূরণ সম্ভব হবে না। ভারতের অভিযোগ, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর ওপর ব্যাপক নির্যাতন হচ্ছে। এই নির্যাতনের সকল দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের তত্ববধায়ক সরকারের। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভিযোগ, সংখ্যালঘুর প্রশ্নটি ব্যবহার করে ভারত আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারতের মদদপুষ্ট হয়ে, সেদেশের মাটিতে বসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ষড়যন্ত্র করছে।
এই অভিযোগের কোনটিই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয়। আগস্ট গনঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর ছোট-বড় নানা ধরনের আক্রমণ হয়েছে, জানমালের ক্ষতিও হয়েছে, একথা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকেই স্বীকার করা হয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে, অবস্থার লক্ষ্যণীয় পরিবর্তনও হয়েছে।
অন্যদিকে, ভারতের মাটি থেকে যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে, একথা অস্বীকার করার জো নেই। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। পশ্চিম বাংলায় তাদের ডাকে বাংলাদেশ মিশনের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে, বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয়েছে। সংখ্যালঘু প্রশ্নে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানিয়ে ভারত সরকার জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে। এক হিন্দু নেতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী তুলেছেন, যদিও ব্যবস্থা গ্রহণ মানে সামরিক অভিযান কিনা, সে কথা খোলাসা করে বলেননি।
হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে ভারত যে বক্তব্য দিয়েছে, তাকে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, একথা বলায় খুব যৌক্তিক জোর নেই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের প্রতিবাদ ও নিন্দা শুধু ভারত নয়, হোয়াইট হাউসে ও বৃটিশ পার্লামেন্টেও জানানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, তা কেউ বলেনি। আমরা জানি, সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার সংরক্ষণের ভিত্তি আন্তর্জাতিক আইনে রয়েছে। একাধিক সনদ রয়েছে আমরাও যার স্বাক্ষরকারী। ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র যদি সেকথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাহলে অন্যায়ের কিছু নেই। একাত্তরে পাকিস্তানীরা তাদের দেশের পুর্বাংশে পরিচালিত গণহত্যাকে অভ্যন্তরীণ বলে চালাতে চেয়েছিল, পারেনি। সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ এসেছিল ভারত থেকে। আমাদের দুঃসময়ে তারাই ছিল আমাদের পাশে। একইভাবে ভারতে যখন মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়, তখন বাংলাদেশ -তার সরকার, নাগরিক সমাজ ও তথ্যমাধ্যম - প্রতিবাদ জানাবে, সেটাই স্বাভাবিক।
সেটাও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়।
বস্তুত, সংখ্যালঘু প্রশ্নে আমাদের দুইদেশেই যে সমস্যা রয়েছে তা অস্বীকার করার জো নেই। ইউটাহ-র ব্রিগহ্যাম ইয়াং ইউনিভার্সিটির প্রস্তুত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৩০ জন মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর কত হিন্দু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হতাহত হন তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, তবে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এক হাজারেরও বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছ, নিহত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ৪৫।
অন্যকথায়, সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন বাংলাদেশ ও ভারতের উভয়ের জন্যই একটি অব্যাহত সমস্যা। ভারতের কংগ্রেস নেতা রশিদ আলভি গত সপ্তাহে সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হচ্ছে, ভারতেও মুসলিম মসজিদে হামলা হয়েছে। আলভির মতে, ভারতে মুসলিমদের অবস্থা বাংলাদেশের হিন্দুদের চেয়েও খারাপ।
একে অপরকে দোষারোপ না করে এই ব্যাধি নিরাময়ে যদি আমরা একে অপরকে সাহায্য করি, তাতে সংকট থেকে উত্তরণ সহজতর হবে। সাহায্য করা মানে সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তা বাংলাদেশেই হোক বা ভারতে, তা প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই কোন না কোনভাবে ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে জড়িত। এ থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা উভয় দেশের সবচেয়ে চরমপন্থী মহলের, যারা একে অপরের উদাহরণ ব্যবহার করে নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা এগিয়ে নেয়। এটা যে বানানো গল্প নয় তা দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদীর অপ্রতিহত রাজত্ব থেকেই বোঝা যায়।
বাংলাদেশে ইসকন নিয়ে যে দাঙ্গা ও রক্তপাত, তার পেছনে যে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে, তাতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এই জাতীয় পরিস্থিতিতে আমাদের সবার আগে প্রশ্ন করা উচিত, এই দাঙ্গা বাঁধিয়ে কার লাভ? আর যারই হোক সংখ্যালঘুদের নয়। গত দুই দশকের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, বাংলাদেশের হিন্দুদেও পক্ষে দাঙ্গা বাঁধানো কার্যত অসম্ভব, তাদের সে কব্জির জোর নেই, আইন-আদালতের
আশ্রয়পুষ্ট হয়ে হামলা চালানোর পথও খোলা নেই। বরং প্রায় সবক্ষেত্রেই তারা হামলার শিকার। কখনো যদি সংখ্যালঘুদের হাতে সামান্যতম স্খলন ঘটে, তার জবাবে সংখ্যাগুরু কি তান্ডব চালাতে পারে, সে ইতিহাস আমাদের কারোরই অজানা নয়।
অতএব, খোলা চোখেই বোঝা সম্ভব, ইসকন ইস্যুতে গোল বাঁধিয়ে ফায়দা তাদের যারা চলতি সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়। আমাদের দুই দেশেই ধর্ম অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যাপার, একে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করা যত সহজ অন্য কোন ব্যাপারে নয়। হজরত বাল মসজিদ দাঙ্গা (১৯৬৪) থেকে গোধরার সহিংসতা (২০০২) কোনটার ফলেই ধর্মের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে স্বার্থবাদী
রাজনীতিকদের। অনুমান করি, ভারতে বসে ক্ষমতাচ্যুত মহল যারা ষড়যন্ত্রের ঘুটি চালছেন, এই বিশৃংখলা তাদের জন্য দৈবের উপহার।
এই অবস্থা বদলাতে - নিদেনপক্ষে অবস্থার যাতে আরো অবনতি না ঘটে - তারজন্য বাংলাদেশ ও ভারত উভয়পক্ষকেই সংযত হতে হবে। আমাদের দুই দেশের অব্যাহত উত্তেজনার অন্যতম প্রধান কারণ ভারতের মাটিতে শেখ হাসিনার অবস্থান। সেখান থেকেই তিনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাঁকে ফেরত পাঠানো জটিল কূটনৈতিক ও আইনগত ব্যাপার। সে জটিলতা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারত নিদেনপক্ষে যা পারে তা হল হাসিনাকে তার মাটিতে বসে রাজনৈতিক কার্যকলাপ করতে না দেওয়া।
অন্যদিকে ভারতকে সরাসরি আক্রমণ করে যে বক্তৃতা-বিবৃতির প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে দেখছি, তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। আমাদের কোন কোন রাজনৈতিক নেতা, এমনকি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ, কখনো কখনো এমন কথাও বলছেন যাতে মনে হয় ভারতকে ছেটে দিতে পারলেই তারা খুশি।
অথচ ছেটে দিতে চাইলেই আমরা কেউ কাউকে ছেটে ফেলতে পারব না। ভূগোল ও ইতিহাস দুটোই আমাদের অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আমাদের রাজনৈতিক বা আদর্শগত ব্যবধান থাকতেই পারে, কিন্তু সে ব্যবধান আমাদের দুই দেশকে একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে বাঁধা হওয়ার কারণ নয়। ইউরোপে বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে আঞ্চলিত সহযোগিতা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার কেন্দ্রে রয়েছে এই বিশ্বাস যে, প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। কারো রয়েছে অতিরিক্ত কাঁচামাল, কারো রয়েছে প্রতিষ্ঠিত শিল্প ভিত, কারো বা রয়েছে দক্ষ জনশক্তি। একে অপরের সঙ্গে বিরোধীতার বদলে এই স্বভাবগত সুবিধাকে যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে ছোটবড় সব দেশেরই লাভ। আমরাও এই মডেলটি অনুসরণ করতে পারি। আমাদের ক্ষেত্রে এই সহযোগিতার আরো বেশি দরকার, কারণ জলবায়ূ সংকটের মত চ্যালেঞ্জ আমাদের উভয়কেই সমানভাবে মোকাবেলা করতে হবে। অভিন্ন নদীর জলসম্পদ ব্যবহারেও চাই সহযোগিতা। চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি আমাদেও অভিন্ন সীমান্ত, যার দুইপাশে অপরাধ চক্রের অপরাধ বিচরণ। তা ঠেকাতেও চাই সহযোগিতা।
কথায় বলে, এক হাতে তালি বাজে না। একা একা ট্যাঙ্গো নৃত্যও করা যায় না। এই সাধারণ সত্যটি মেনে যদি পস্পররের প্রতি সুবিবেচক ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আমরা এগোই, তাতে লাভ দুজনেরই। সবচেয়ে বড় কথা, ধর্মকে ব্যবহার কওে চুড়ান্তপন্থীদের যদি আমরা ছুড়ে মারার কাষ্টখন্ড নিজেরাই তুলে দেই, সে আগুনে মরব আমরা উভয়েই।
৫ ডিসেম্বর ২০২৪, নিউ ইয়র্ক