রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৬ ১৪৩২   ২১ শাওয়াল ১৪৪৬

মানবিক চিকিৎসক থেকে দানবিক শাসক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪২ এএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ সোমবার

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়াতে গত ২৭ নভেম্বর থেকে হঠাৎ করেই স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে দেশটির বিদ্রোহীরা। অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশটির বিদ্রোহীরা মাত্র ১২ দিনে পতন ঘটিয়েছে সিরিয়ার আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের এবং বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের।

জনরোষ আর সশস্ত্র বিদ্রোহের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সিরিয়ার 'স্বৈরশাসক' প্রেসিডেন্ট আসাদ। তবে ক্ষমতার শুরু থেকেই কি এমন ছিলেন আসাদ?

১৯৬৫ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বাশার আল আসাদের জন্ম। দামেস্কে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। দামেস্ক ইউনিভার্সিটি থেকে চক্ষুবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেন।

বড় ভাই বাসিল আল-আসাদ ছিলেন পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। অন্যদিকে বাশার রাজনীতির বাইরে থেকে লন্ডনে চোখের ডাক্তার হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। চিকিৎসক হয়ে মানুষের মানবিক সেবাই ছিল বাশারের লক্ষ্য।

তবে ১৯৯৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বড় ভাই বাসিলের মৃত্যুর কারণে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছাকে বাদ দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হতে হয় বাশারকে। ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে উত্তরসূরি হিসেবে দেশের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেন বাশার আল-আসাদ।

শাসনামলের শুরুর দিকে বাশার সংস্কারের ভূমিকা রাখেন। প্রশাসনিক-রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হাঁটেন। এ ক্ষেত্রে বাবার আমলের বেশ কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন তিনি।

তবে পরিস্থিতি ক্রমেই বদলে যায়। সংস্কারকের ভূমিকা থেকে আসাদ কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠতে শুরু করেন। বিরোধী মত দমনে তাঁর কুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। সিরিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয় অনেক সরকারবিরোধী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীকে। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা গণতন্ত্র সিরিয়ার জন্য নয়।’

বাশার ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই সিরিয়ার তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্‌স্বাধীনতার অভাববোধ থেকে তুমুল হতাশা ছিল, যা উসকে দেয় আরব বসন্ত।

২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণের শহর দেরাতে প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমাতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান বাশার। ব্যাপক দমন–পীড়নের মুখে বিক্ষোভকারীরা বাশারের পদত্যাগের দাবি তোলেন। এতে বেড়ে যায় দমন–পীড়ন। সেই সঙ্গে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিরিয়ায়।

    ‘আল্লাহু আকবার’ বলে আসাদের বাবার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে বিদ্রোহীরা‘আল্লাহু আকবার’ বলে আসাদের বাবার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে বিদ্রোহীরা

টানা ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের কারণে ধন-মান-ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ দেশ বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে দেশটিকে। দীর্ঘ এই গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ মানবিক সংকট শুরু হয় সিরিয়ায়।

বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একইসাথে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু, অবকাঠামোকে ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে চরম দুর্দশায় ফেলেছে। এটি এমন একটি মানবিক সংকট তৈরি করেছে যেখান থেকে পুনরুদ্ধারের কোনো সুস্পষ্ট পথ নেই।

২০২১ সালের জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে সিরিয়ান সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন নৃশংসতা নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রাসায়নিক হামলা, জনবহুল এলাকায় বিমান হামলা, বেসামরিক মানুষদের ক্ষুধার্ত রাখতে দেয়া অবরোধ এবং মানবিক সাহায্যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ।

জাতিসংঘের ধারণা, যুদ্ধের কারণে ২০২২ সাল নাগাদ আনুমানিক তিন লাখ ছয় হাজার ৮৮৭ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। আরও হাজার হাজার মানুষ অনাহার, রোগ এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে মারা গেছে।

এছাড়া, সিরিয়ায় যুদ্ধের আগের দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া ৬৮ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি লোক সীমিত সুবিধা নিয়ে ভিড়ে উপচে পড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে।

এর বাইরে আরও প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দেশটি ছেড়ে পালিয়েছে, যার বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে। এসব দেশে সবমিলিয়ে ৫৩ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী রয়েছে।

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক জুলিয়েন বার্নেস-ডেসি বলেন, "এই যুদ্ধের কেন্দ্রে আছে কর্তৃত্ববাদ"।

সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা ও ইন্টারনেট