মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৮ ১৪৩২   ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬

হার্টের রিং বাণিজ্যর পর এবার ভুল চিকিৎসায় দুই মৃত্যুর অভিযোগ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৩ এএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ সোমবার

এক রিং পরিয়ে টাকা নেন তিনটার
 

 

হার্টের রিং পরানো নিয়ে বাণিজ্যর অভিযোগের পর এবার ভুল চিকিৎসায় পৃথক দুই রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

রিং বাণিজ্যর খবরে আলোচনায় আসা ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর এ অভিযোগ তুলেছেন খোদ একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহীন শাহ্। রমেক হাসপাতালের আলোচিত এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ নিয়ে মোট চারটি পৃথক অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে রমেক হাসপাতালে। তবে সব অভিযোগ এক বাক্যে অস্বীকার করেছেন ডা. মাহাবুবুর রহমান।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর ডা. শাহীন শাহ’র আপন খালু আফজাল হোসেনের (৬৫) হার্টে রিং পরান ডা. মাহাবুবুর রহমান। অপারেশনের কিছু সময় পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আফজাল হোসেন। এই ঘটনার জেরে গত ৭ ডিসেম্বর ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত অভিযোগ করেন ডা. শাহীন শাহ। একইভাবে ডা. মাহাবুবুরের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় লাল মিয়া (৫০) নামের এক ব্যক্তির মারা যাওয়ার লিখিত অভিযোগ করেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গুজাপাড়া গ্রামের ফরিদা বেগম নামের এক নারী। এই দুইটি অভিযোগের কপি রোববার (৮ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। এ নিয়ে ডা. মাহাবুবের বিরুদ্ধে রিং বিক্রি ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর মোট চারটি লিখিত অভিযোগ করলেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের কপি দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রমেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জন অফিসে ডাকযোগে এবং সরাসরি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ তদন্তে গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের কমিটি।

অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও ডা. মাহাবুবুর রহমানকে বাঁচাতে মারিয়া হয়ে উঠেছে একটি মহল। স্পর্শকাতর এসব অভিযোগ বিষয় ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এমনকি তদন্ত কমিটিতে কারা আছেন এবং কয়দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট হবে তা গোপন রেখেছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান। দীর্ঘদিন ধরে ডাক্তার ও নার্সরা ডা. মাহাবুবের বিরুদ্ধে রিং ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি বিক্রির অভিযোগ দিলেও কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হরিপদ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেননি বলেও জানিয়েছে হাসপাতাল সূত্র। এ সংক্রান্ত কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ সাংবাদিকদের হাতে এসেছে।

এমন অভিযোগের রেশ না কাটতেই গত শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন ডা. শাহীন শাহ। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ডা. মাহাবুবুর রহমান আমার পূর্ব পরিচিত, ঘনিষ্ঠ ও সহকর্মী হওয়ার বিশ্বাসের জায়গা থেকে তার অধীনে আমার খালুকে ভর্তি করি। ডা. মাহবুবুর রহমান আমার খালুর এনজিওগ্রাম করেন গত ৭ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ সকালে। রিং পরানোর সময় ‘আটার্রিপারফোরেশন’ হয়ে গেলে অর্থাৎ হার্টের রক্তনালীতে ফুটা হয়ে গেলে রক্তক্ষরণে আমার খালু ওই দিনই (০৭/১১/২০২৩) কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান।

তিনি আরও বলেন, ‘আটার্রিপারফোরেশন’ হয়ে গেলেও ডা. মাহাবুব আমাকে বা মেডিকেলে উপস্থিত আমার খালাকে কিছুই জানাননি বরং তিনি রিং লাগানোর কার্যক্রম বন্ধ করে রেজিস্ট্রার খাতায় ‘ক্যানসেল’ লিখেন এবং ভুল ও অবহেলায় আমার খালুর মৃত্যুর দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। এনজিওগ্রাম ও রিং পরানোয় ভুল ও অবহেলা হওয়ায় আমার খালু মারা যান। কিন্তু পরবর্তীতে একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু জাহেদ বসুনিয়া স্যারের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারি যে আমার খালুর রক্তনালীতে রিং না পরালেও চলতো।

ডা. মাহাবুবুর রহমানের প্রভাবের কারণে এতদিন অভিযোগ করতে পারেননি উল্লেখ করে শাহীন শাহ আরও বলেন, আমি জেনেছি ডা. মাহাবুবুর রহমান রিং বিক্রির উদ্দেশ্য বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেন। এমনকি, তিনি অননুমোদিত ভুয়া ডিগ্রি এমডি (কার্ডিওলজি) ব্যবহার করেন।

একইভাবে রোববার (৮ ডিসেম্বর) ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় লাল মিয়ার মৃত্যু হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ করেছেন ফরিদা বেগম নামের এক নারী। তিনি লিখিত অভিযোগে বলেন, গত ২৭ নভেম্বর ডা. মাহাবুবুর রহমান তার স্বামী লাল মিয়ার এনজিওগ্রাম করেন এবং তাকে না জানিয়েই অপারেশন করে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরান। অপারেশনের চারদিন পর গত ১ ডিসেম্বর ডা. মাহাবুবুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান লাল মিয়া।

দু’টি গরু ও মানুষের কাছে টাকা চেয়ে চিকিৎসার টাকা সংগ্রহ করেছিলেন উল্লেখ করে ফরিদা বলেন, আমার স্বামীর শারীরিক অবস্থা রিং লাগানোর মতো ভালো ছিল না। তবু ডা. মাহবুবুর রহমান রিং লাগিয়ে দেন। তার ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে আমার স্বামী মারা গেছেন।

এর আগে ডা. মাহাবুবুর রহমানের রিং বাণিজ্যর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে অভিযোগ করেন মো. মশিউর রহমান ও আতোয়ার রহমান নামের দুই ভুক্তভোগী। আতোয়ার রহমান অভিযোগ করেন, ডা. মাহাবুবুর তিনটি রিং লাগানোর কথা বলে তিন লক্ষ বিশ হাজার টাকা নিয়েছেন কিন্তু রিং লাগিয়েছেন একটি। বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে অভিযোগ হওয়ার পর নিজেকে বাঁচাতে মাহাবুবুর রহমান হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার খাতায় একটি রিং এর স্টিকারের পাশে জালিয়াতি করে আরেকটি রিং পরানোর স্টিকার বসিয়েছেন যাতে মনে হয় তিনি দুটি রিং পরিয়েছেন। বর্তমান রেজিস্ট্রার খাতার কপি ও আগের কপি সাংবাদিকদের হাতে এসেছে।    

রংপুরের গঙ্গাচড়ার আরেক ভুক্তভোগীর ছেলে মো. মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে জানান, পেটে ব্যথা হলে গত ১১ সেপ্টেম্বর তার মাকে নিয়ে ডা. মাহাবুবুর রহমানের কাছে গেলে তিনি এনজিওগ্রাম করাতে বলেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি এনজিওগ্রাম করেন এবং বলেন যে, তার মায়ের হার্টের রক্তনালিতে ৭৫ শতাংশ ব্লক আছে। তাকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে রিং (স্টেন্ট) পরাতে হবে। বিষয়টি সন্দেহ হলে ঢাকা ন্যাশন্যাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. বদিউজ্জামানকে এনজিওগ্রামের সিডি (রেজি নম্বর ১২৫২২/৩২) দেখালে তিনি জানান, তার মায়ের হার্টে কোনো ধরনের ব্লক নেই।