সম্পদ সন্ত্রাস ক্ষমতার পঙ্কজ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:০৮ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ মঙ্গলবার

বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখল, চর দখল, ইলিশ সিন্ডিকেট গড়ে তোলা, পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং হত্যায় মদদ দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, তার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট বহু মানুষের জীবনে অন্ধকার নিয়ে এসেছে। এক যুগ ধরে মেঘনার তীরাঞ্চল থেকে শুরু করে রাজনীতির অলিগলিতে দাপট ছিল তার। তিনি এখন নির্যাতনের প্রতীক। তার বিরুদ্ধে দলের ভেতরে ক্ষোভ রয়েছে, তার কারণে জনগণের ক্ষতি হয়েছে। নানা অপরাধের অভিযোগে তার রাজনৈতিক জীবন বিতর্কের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
২০১৪ সালে বরিশাল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পঙ্কজ দেবনাথ একের পর এক বিতর্কে জড়ান। এ কারণে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। গত জাতীয় নির্বাচনে দল তাকে মনোনীত করেনি। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছিলেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, পঙ্কজ দলের ভেতরে বিভাজন তৈরি করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ভাষ্য অনুযায়ী, পঙ্কজের কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনগণ এখন দল নয়, তার অপকর্মগুলো সম্পর্কেই বেশি জানে।
দুদকসহ একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পঙ্কজ দেবনাথের ঢাকায় একাধিক বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে সম্পত্তি আছে। তার বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগও আছে। স্থানীয় নেতাদের দাবি, তার অঢেল সম্পদের মূল উৎস ইলিশ সিন্ডিকেট, জমি দখল এবং বালুমহালের অবৈধ আয়।
দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চরে জমি দখল করে বছরে ১০ কোটি টাকা আয় করতেন পঙ্কজ দেবনাথ। আলিমাবাদ ইউনিয়নে খাসজমি দখল করে ভুয়া কাগজপত্রও তৈরি করেছিলেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, তারা চরে ফসল ফলানোর জন্য জমি ব্যবহার করতে পারতেন না। যারা জমি ব্যবহার করতে চেয়েছেন, তাদের চাঁদা দিতে বাধ্য করা হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘তার কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। সাধারণ মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন।’
মেহেন্দীগঞ্জের ধুলখোলায় বালু উত্তোলন নিয়ে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘পঙ্কজ দেবনাথের সিন্ডিকেট প্রতিদিন বালু উত্তোলন করে ঢাকায় পাঠাত। প্রতিটি ড্রেজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হতো। বালু তোলার কারণে আমাদের নদীতে ভাঙন বেড়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকেই পথে বসেছেন।’
মেঘনা নদীর ইলিশের ব্যবসায় পঙ্কজ দেবনাথের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট প্রায় এক যুগ ধরে নদী এলাকার মানুষকে শোষণ করেছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ কোটি টাকার ইলিশ মেঘনা নদী থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধভাবে শিকার করা হতো।
জেলেরা জানান, সিন্ডিকেটের সহযোগীরা নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে তাদের ইলিশ ধরতে বাধ্য করত। নিষেধাজ্ঞার সময় জানপুর মাছঘাট থেকে প্রতি রাতে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করা হতো।
মেঘনার তীরবর্তী আবুপুরের জেলে শফিক গাজী বলেন, ‘পেটের দায়ে মাছ ধরি, কিন্তু সিন্ডিকেট ছাড়া ঘাটে মাছ বেচতে পারি না। তাদের কমিশন দিয়েও শান্তি নেই। নিয়ম ভাঙলেই শাস্তি।’
মিলন হাওলাদার জানান, ‘জানপুর মাছঘাটে সিন্ডিকেট আমাদের মাছ জোর করে কম দামে কিনে নেয়। তাদের সঙ্গে প্রশাসনের লোকজনও হাত মিলিয়েছে।’
মেহেন্দীগঞ্জের গোবিন্দপুর এলাকার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘পঙ্কজ নাথ আর তার অনুসারীরা চর দখল করে চাষবাসের জমি অধিকার করেছেন আর গরু-মহিষ চরানোর জায়গা করেছে। গরিব মানুষের জমিকে নিজেদের আয়ের উৎস বানিয়েছে। প্রতিবাদ করলে হুমকি দেয়।’
মাছঘাটের একজন ম্যানেজার জানান, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় মাছের দাম কমে এক-চতুর্থাংশ হয়ে যেত। সিন্ডিকেট সেই মাছ কিনে নিত এবং বাজারে চড়া দামে বিক্রি করত। আমরা তাদের নিয়ম অমান্য করলে চাকরি হারানোর শঙ্কা থাকত।’
পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে গত আট বছরে ১১ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। বরিশাল জেলা পরিষদের প্রশাসক মইদুল ইসলাম ২০১৭ সালের ২৩ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় বিহঙ্গ পরিবহনে পেট্রলবোমা হামলায় ১১ জন নিহত হন। এ হামলার নির্দেশ পঙ্কজ দেবনাথই দিয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক স্বার্থে। মইদুল ইসলামর বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহানুভ‚তি অর্জন করে দলীয় মনোনয়ন পাওয়াই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত নেতাকর্মীসহ যেই পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে গিয়েছেন তারাই হামলা, খুন অথবা এলাকা ছাড়া হয়েছেন।
কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগের কর্মী সঞ্জয় চন্দ্র জানান, ‘আমি তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাকে হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। প্রাণনাশের হুমকির কারণে আমি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।’
মেঘনা নদীর তীরবর্তী মানুষ পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত ও সিন্ডিকেটের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। জেলে শফিক গাজী বলেন, ‘তার অপরাধের বিচার চাই। আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে আইনের আওতায় নিতে হবে। তার হাত অনেক লম্বা।’
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর পঙ্কজ দেবনাথকে তার নির্বাচনী এলাকায় দেখা যায়নি। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। অভিযোগ প্রসঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের মন্তব্যও পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যদি যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়, তাহলে মেঘনার তীরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।