সনদ বিক্রির কারখানা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৯:৫২ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখনো নিয়মের মধ্যে পরিচালিত করতে পারছে না সরকার। ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব, মামলা, সনদবাণিজ্যসহ আরও অভিযোগে অভিযুক্ত দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই পড়ালেখার প্রয়োজনীয় পরিবেশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন বেহাল দশা। নানা সংকটে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেদার সনদবাণিজ্য হওয়ায় প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দপ্তর থেকে ইউজিসিতে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) আসছে সনদ যাচাইয়ের আবেদন।
তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১০৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার ২০০৬ সালে বন্ধ ঘোষণা করে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি। এ আদেশের বিরুদ্ধে আদালত ২০১৩ সালে রায় প্রদান করেন। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদিত কোনো ক্যাম্পাস নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনগত আর কোনো ভিত্তিও নেই। কিন্তু রাজধানীর বারিধারায় একটি ভবনের সামনে এখনো শোভা পাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড।
সূত্র জানায়, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের আমলে লাগামহীনভাবে পরিচালিত হওয়া বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নজরদারিতে রেখেছে ইউজিসি। এর মধ্যে রয়েছে- অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ডসহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। আওয়ামী আমলে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দখল হওয়ার অভিযোগে ইউজিসির কর্তাব্যক্তিরা এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্তে নামছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী আমলে খেয়াল-খুশিমতো চলেছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। আত্মীয়করণের কারণে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া, নির্ধারিত সময়ের আগে কোর্স শেষ করা ছাড়াও রয়েছে নানা অভিযোগ। আওয়ামী আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয় মরতে বসেছে ট্রাস্টিদের দ্বন্দ্বে। ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান প্রতিবেদককে অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দুর্নীতি করেছেন সাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে। অভিযুক্ত সালাহউদ্দিনকে সম্প্রতি ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সুষ্ঠু একাডেমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারক সংস্থা ইউজিসিতেও অনেক কর্মকর্তা এই অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে চাকরি করছেন। এখন রয়েছেন পদোন্নতির অপেক্ষায়। সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লারও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই বর্তমানে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অনেক জাল সনদ বিতরণ করা হয়েছে বলে ইউজিসি কর্মকর্তাদের অভিযোগ। নির্ধারিত সময়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাকার্যক্রম স্থানান্তরে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রেখেছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে। সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট নিয়ে জটিলতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও মামলা চলমান রয়েছে এখানে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব প্রোগ্রামের নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রয়েছে। আর্থিক একাডেমিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটিতে। এ বিশ্ববিদ্যালয় নামে একাধিক মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত কোনো ট্রেজারার নেই। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ এস এম ফায়েজ বলেন, বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ম মেনে চলছে। তবে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় কখনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। আইন না মেনে যেনতেনভাবে আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মের মধ্যে পরিচালনা করতে সব রকমের উদ্যোগ নেব। আমরা কারও বিরুদ্ধে কঠোর হতে চাই না, তবে নীতিতে অটল থাকব।