শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১   ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সূর্য ডুবলেই ভয়ংকর ঢাকা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৪ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

রাজধানী যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী স্কুলের সামনে ওয়াসার কর্মচারী হোসেন আলীকে ঘিরে ধরে চার ছিনতাইকারী। অর্থ, মোবাইল দিয়ে দেন ছিনতাইকারীদের। তারপরও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় গতকাল বুধবার ভোরে ফাঁকা সড়কে ফেলে যায় ছিনতাইকারীরা। হোসেন আলী এখন মালিবাগের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে মঙ্গলবার রাতে মতিঝিলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র রিপোর্টার মাইনুল হাসান সোহেলের মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। শুধু হোসেন আলী কিংবা মাইনুল হাসান নন, গত চার মাসে রাজধানীতে বহু মানুষ একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন শতাধিক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সূর্য ডুবলেই রাজধানীর অলিগলি থেকে রাজপথের অধিকাংশ এলাকা ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে। গণছিনতাই নগরবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। রাতের ঢাকায় টহল পুলিশের দেখা কম মেলায় আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়েছে। নগরবাসীর মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দিনে দুই শতাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত হুঙ্কার দিলেও একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলছে। রাজপথে চাপাতি হাতে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের

সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিসতর্কতার সঙ্গে মাঠে দায়িত্ব পালন করছে। তারা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। যৌথ বাহিনীর জোরালো সাঁড়াশি উদ্যোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যম কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ না থাকায় ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে জোরালোভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

গত ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর আসাদগেটের একটি ছিনতাইয়ের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, সিগন্যালে যানবাহন থেমে থাকা সড়কে চাপাতি হাতে ঘুরছে তিন যুবক। একপর্যায়ে একটি প্রাইভেটকারের জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন নিয়ে ভোঁ-দৌড় দেয় ছিনতাইকারীরা। পথচারীরা বলছেন, প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের এসব ভিডিও দেখে ঘরের বাইরে বের হতে ভয় লাগে। ছুরি-চাপাতি নিয়ে টাকা-পয়সা, মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ার পর যেভাবে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়, তাতে জীবন হাতের মুঠোয় রেখে বাসার বাইরে বের হতে হয়।

তবে একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলছেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া পিতা-মাতা সন্তানদের হাত খরচ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব কিশোর-তরুণ চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু কলকারখানাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এসবের বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমাজের ওপর। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা বাড়তে পারে।

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ছিনতাইকারীদের ধরার অভিযান চালাতে ডিএমপির সব বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক দিনে দুই শতাধিক ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

গত ১৮ জুলাই হাফেজ কামরুল হাসান রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাকে কুপিয়ে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। তরুণ কামরুল হাসান ঘটনাস্থলেই মারা যান। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার মগবাজারে হাবিব উল্লাহ নামে এক তরুণ ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। পরের দিন ১৬ ডিসেম্বর ছুটির দিন সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে মফিজুল ইসলাম সাদিক নামে এক সংবাদকর্মীর মোবাইলটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে অনেক নতুন মুখ ও অপেশাদাররা ছিনতাই করছে। যাত্রাবাড়ীতে হাফেজ কামরুল হাসানকে যে ছিনতাইকারীরা খুন করেছে তাদের বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছর। গত কয়েক দিনে পুলিশ যে দুই শতাধিক ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করেছে, তাদের অধিকাংশের বয়স ১৫ থেকে ২২ বছর। মাদক কিনতে ও হাত খরচের টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ছিনতাইকারীরা অপেশাদার হওয়ায় তারা কোনো রকমের ঝুঁকি না নিয়ে এলোপাতাড়ির পথচারীদের কোপাচ্ছে।

পুলিশ ও ঢাকার আদালত সূত্র বলছে, রাজধানীতে গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন শতাধিক ভুক্তভোগী। একই সময়ে ঢাকায় সর্বাধিক তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা অভিযোগকারীদের কয়েকগুণ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটলেই কেবলমাত্র প্রকাশ্যে আসে। অধিকাংশ ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তি থানায় অভিযোগ করতে চান না। কারণ জিডি কিংবা মামলা করে ছিনিয়ে নেওয়া অর্থ ও মালামাল ফেরত পাওয়ার নজির খুবই কম।