নতুন বছর ২০২৫
উদ্বেগ উৎকন্ঠা ও অনিশ্চিত যাত্রা
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৩০ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ শনিবার
বিদায়ী বছরের মাঝামাঝি আন্দোলনের মুখে অচল হয়ে পড়েছিলো বাংলাদেশ। শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে অনেকে তখন শেখ হাসিনার অপসারণকেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ ভেবেছিলেন। ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্টের অভ্যূত্থান সেই পথকে সুগম করেছিল। একটা স্বস্তিদায়ক ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবে বলে আশা করা হয়েছিলো। বাস্তবে তেমন কিছু ঘটলো না। একটা অচলায়তন থেকে অনিশ্চয়তার পথেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। নতুন বছর ২০২৫ সাল অস্থিরতার মধ্যে কাটবে বলে মনে হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তি সরকার নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সামনের পথ খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। একটা জটিল, অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নতুন বছরটা কাটবে বলে মনে হচ্ছে। সংস্কার কতটা হবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দল ২০২৫ সালেই নির্বাচন চাইছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব ও জামায়াত সংস্কার শেষে ২০২৬ সালে নির্বাচনের পক্ষে। নির্বাচন নিয়ে সরকারের ভেতরেই ২টি মেরুকরণের জন্ম নিয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
ছাত্ররা সরকারী চাকুরীতে কোটা ব্যবস্থা সীমিত করার দাবিতে বিদায়ী ২০২৪ সালের মাঝামাঝি আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই ছিলো। পরে ধীরে ধীরে সহিংস হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। আন্দোলনটা এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে রুপ নেয়। বিদায়ী বছরের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করেন। আশ্রয় নেন ভারতে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারে পুর্নগঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের লক্ষ্যে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিলো শেখ হাসিনার আমলে। কঠিন এক বাস্তবতা হলো, একই ট্রাইব্যুনাল পুর্নগঠন করে এখন শেখ হাসিনার বিচারের আয়োজন করা হচ্ছে।
ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে অর্ন্তবর্তি সরকার। ভারত কোনও জবাব দেয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রি ঢাকা সফরকালে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। এই বাস্তবতা মেনেই তারা অর্ন্তবর্তি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ভারতের অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়া ভারতের পক্ষে সহজ নয়। কারণ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু। দেশটির একাধিক বিশ্লেষক বলছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনি ও রাজনৈতিক বিষয় জড়িত। শেখ হাসিনা সঠিক বিচার পাবেন কিনা সেই প্রশ্ন তারা তুলছেন। জামায়াতের পক্ষের প্রসিকিউটরই এখন শেখ হাসিনার বিচারে প্রসিকিউটর হয়েছেন। তাছাড়া, ইউনূসের সরকার গণতান্ত্রিক সরকার নয়। দুই দেশের মধ্যে প্রত্যার্পন চুক্তিতেও রাজনৈতিক কারণে আশ্রিত কাউকে প্রত্যার্পনের সুযোগ নেই। এখন শেখ হাসিনাকে ভারত রাজনৈতিক বন্দি নাকি অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত কিভাবে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি হিসেবে অবস্থান করবে তাও ভাববার বিষয়। সম্পর্ক কি সংঘাতের দিকে গড়াবে? সেখানকার দ্বিতীয় স্তরের রাজনীতিবিদরা উস্কানীমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। তা কোন পর্যায়ে যায় তাও দেখবার বিষয়। দু’দেশের মধ্যকার উত্তেজনা যেকোন মুহূর্তে কূটনীিিতর সীমারেখা ভেঙ্গে দিতে পারে। উভয় দেশের মানুষই অস্বস্তি নিয়েই নতুন বছরের প্রহর গুণছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। ৮ই আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পূর্ব পর্যন্ত দেশে বিশ্খৃলা ছিলো। তখন প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বহু আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িঘর কিংবা অফিস ভাংচুর হয়েছে। হিন্দু সংখ্যলঘূদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পরিস্থিতি উন্নতি করার লক্ষ্যে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এবং একই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও একটি রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এবং সরকারের মধ্যে কিছুটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। কিন্তু অর্ন্তবর্তি সরকার বেশ কিছু সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন দিতে চাইছে। এদিকে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হচ্ছে। ফলে ইউনূসের অর্ন্তবর্তি সরকার নির্বাচন করবে নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
এদিকে, জানুয়ারিতে প্রফেসর ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন্। এই বৈঠকে কতটা সংস্কার করা হবে সে ব্যাপারে একটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা হবে। তার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী রোডম্যাপ দেবেন বলে ঘোষণা রয়েছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি কিংবা ১৪ দলীয় জোটের দলগুলো আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা কিংবা তারা নির্বাচনে অংশ নেবার সুযোগ না পেলে ওই নির্বাচন অর্ন্তভুক্তিমূলক হবে কিনা এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। আগস্ট বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে এমন কিংস পার্টি গঠনকে দলগুলোর পক্ষ থেকে সমালোচনা করা হয়। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ছাত্র সমন্বয়কারীদের সেফ এক্সিট নিশ্চিত না করে ড. ইউনূস বিদায় নিতে চাইবেন না।
অর্ন্তবর্তি সরকার দেশের রুটিন দায়িত্ব পালনে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেবার তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বরং ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি দিনে-দুপুরে একটি ব্যাংকে ঢুকে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে। খেুতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সময় টিভির মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কয়েকজন সাংবাদিককে ছাঁটাই করার জন্য চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠছে। অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন দেয়াকে যৌক্তিক দাবি মনে করছে বিএনপি।
বিএনপি এই দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। অর্ন্তবর্তি সরকারকে সমর্থনের আশ^াস দিলেও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে আসতে পারছেন না সেই প্রশ্ন উঠছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সবগুলো মামলার নিস্পত্তির পর তিনি দেশে আসবেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে ঘোলাটে হচ্ছে তাতে ২০২৫ সাল বেশ অস্থিরতার মধ্যে কাটবে বলে অনুমান করা যায়। বিএনপি প্রশ্ন তুলছে, এই সরকারের করা সংস্কারের বৈধতা দেবে কে। কোনও নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংস্কার টেকসই হবে না বলেও বিএনপি নেতাদের অভিমত।