বিএনপি-জামায়াতের মধুচনিদ্রমার অবসান!
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৩০ এএম, ৪ জানুয়ারি ২০২৫ শনিবার
হানিমুনের পালা শেষ। বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরেছে। বিচ্ছেদের সুরও স্পষ্ট। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছে দল দু’টি। অতীতে একত্রে সরকারও গঠন করেছিলো। কিন্তু এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ করছে। এতে করে বিভেদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে আগামী নির্বাচন ঘিরে একটা নতুন মেরুকরণের আভাসই দিনে দিনে উঁকি দিচ্ছে। বিএনপি এবং জামায়াত আলাদাভাবে জোট করে ভোটে অংশ নেবার সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিচ্ছে না। বিএনপি ও জামায়াত পরস্পরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলছে। জামায়াতে ইসলামীর তরফে বিএনপি’র প্রতি ইঙ্গিত করে প্রায়শই বলা হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজরা বিদায় নিলেও একই কায়দায় অন্যরা চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। জামায়াতের এই অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য -- এমন কথা বলা যায় না। সত্য হলেও মিত্র দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আঙ্গুল তোলার মানে নতুন মেরুকরণের আভাস বলে প্রতীয়মান হওয়া। অপরদিকে, জামায়াতের বিরুদ্ধেও প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলের নেতা রুহুল কবির রিজভী জামায়াতকে লক্ষ্য করে বলেছেন, একটি ইসলামিক দল একটি ব্যাংক দখল করে নিয়েছে।
বিএনপি - জামায়াতের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে দূরত্ব তৈরী হয়েছে। বিগত বছরের ৩১ শে ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ, যারা শেখ হাসিনাকে উৎখাতের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’ নামের একটি ঘোষণা দেবার সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, জুলাই প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের কবর রচনা হবে। পাশাপাশি, আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক দল হিসাবে ঘোষণা দেয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে যা ঘোষণা করা হবে তা রেট্রোস্পেকটিভ কার্যকর হবে ৫ আগস্ট থেকে। শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের দিন থেকে যে ঘোষণা কার্যকর হবে সেটি অনেকাংশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বৈষম্যবিরোধীূ ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগের সমালোচনা করে বলেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের কবর রচনা করার মতো মন্তব্য প্রকৃতপক্ষে একটি ফ্যাসিবাদি উচ্চারণ।
আজকাল ফ্যাসিবাদ শব্দটা খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে। কিন্তু মির্জা আব্বাস এটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী হিসাবে অভিহিত করার মাধ্যমে বিএনপি’র অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস শুধু বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্যই নন; বরং তিনি একজন সাবেক মন্ত্রীও। বিএনপি’র আরেক নেতা গয়েশ^র চন্দ্র রায়ও জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার সমালোচনা করেন। জুলাই প্রক্লেমেশন নিয়ে বিএনপি’র ভিন্ন অবস্থান দেখে টনক নড়েছে অর্ন্তবর্তি সরকারের। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, জুলাই প্রক্লেমেশনের ঘোষণার ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আনেন্দালনের উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের সায় নেই। বরং অর্ন্তবর্তি সরকার সকলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রক্লেমেশন প্রণয়ন করবে। জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে ওই ঘোষণাপত্র প্রণীত হবে। অর্ন্তবর্তি সরকারের এমন ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রায় দেড়শ’ সমন্বয়ক বৈঠক করে ঘোষণাপত্র দেবার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তারা ৩১ ডিসেম্বর পদযাত্রা করে সরকারকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে প্রক্লেমেশন প্রণয়ন করার দাবি জানায়। ফলে বাংলাদেশে বিভেদের রাজনীতি থেকে আপাতত রেহাই মিললেও অনৈক্যের সুর স্পষ্ট হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রক্লেমেশন নিয়ে টু শব্দটি করেনি জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত অনেকটা নীরবে এই প্রক্রিয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়ে গেছে। অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তি সরকার প্রধানত বিএনপি’র পরামর্শকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। শেখ হাসিনার বিদায়ের মাধ্যমে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় আপাতত বিএনপি বাংলাদেশের একমাত্র বড় দল। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই বিএনপি বাংলাদেশে দ্রুত একটি নির্বাচন দাবি করছে। তবে অর্ন্তবর্তি সরকার অনেকটা সময় নিয়ে সংস্কার করার পর নির্বাচনে আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বেশ পাল্টাতে শুরু করেছে। ডেমোক্রেটিক দলের শাসনামলে ড. ইউনূসের সরকার বেশ স্বস্তিতে ছিলো। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় যাবার পর পরিস্থিতির ওপর ভারতের একটা প্রভাব সূচিত হয়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যথেষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই কারণে আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তি সরকার দ্রুত নির্বাচনমুখি হতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। নতুন দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রও তৈরী হচ্ছে। রাজনীতিতে এই নতুন দল এককভাবে নির্বাচন করে আসন জয়লাভ করা কঠিন। আপাতত মনে হচ্ছে ছাত্রদের দল জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে যাবে। যদি মেরুকরণ এমন হয় যে, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন দল জোট গঠন করে তবে বিএনপি নিশ্চয়ই একটা জোট গড়ে তোলবে। এমন হলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত মুখোমুখি হতে পারে।
বিএনপি’র নির্বাচনী কৌশল আরও স্পষ্ট হবে ফেব্রুয়ারি মাসে। আগামী ৬ই জানুয়ারি খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারিতে তারেক রহমান বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। তারেক রহমান প্রত্যাবর্তন করলে বিএনপিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হতে পারে।
এদিকে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে কোনও বাঁধা নেই। আওয়ামী লীগ একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। সরকার কিংবা আদালত দলটিকে নিষিদ্ধ না করলে আগামী নির্বাচনে কোনও না কোনও ফর্মে আওয়ামী লীগ অংশ নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ সরকার ও নির্বাচন কমিশন একটি অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচন চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা জানার জন্য আরও খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। ##