নিম্নমানের পণ্যের কারণে নামিদামি ব্র্যান্ড বিপাকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১১ এএম, ৮ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার নাম উঠতেই কারও মনে হবে এখানে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য বিক্রি হয়। দেশি-বিদেশি গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া যাবে। যা সচরাচর বাজারে পাওয়া যায় না। মেলাকে ঘিরে বিদেশি পণ্যের সঙ্গে দেশীয় ক্রেতাদের পরিচিতি এবং দেশীয় পণ্যের সঙ্গে বিদেশিরা পরিচিত হবেন। তবে বাস্তবিক অর্থে উলটো চিত্র দেখা গেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায়। মেলার ভেতরে নিুমানের পণ্য ফুটপাতের মতো করে সাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে অবাধে। মেলায় ঢুকতেই শোনা যায় বাইছা লন একশ, যেইটা লইবেন একশ-এ রকম কোরাসে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। দূর থেকে এ ধরনের স্লোগান শুনলে যে কারও মনে হতে পারে গুলিস্তান, ফার্মগেট অথবা নিউমার্কেটের কোনো ফুটপাতে গিয়েছেন। এ চিত্র দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক দর্শনার্থী। বাণিজ্যমেলার নামের আগে ‘আন্তর্জাতিক’ থাকলেও কাজে আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখতে পারেনি বলে দাবি দর্শনার্থী ও সংশ্লিষ্টদের।
চকবাজারের বিভিন্ন মানহীন পণ্যে সয়লাব মেলার বেশির ভাগ স্টল। পণ্য নিম্নমানের হলেও দাম কয়েকগুণ বেশি। সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মূল উদ্দেশ্য থাকে বিদেশি ক্রেতা-বিক্রেতা অংশ নেবেন এবং পণ্যের গুণগত মান যাচাই করবেন। পছন্দ হলে কিছু পণ্যের ক্রয়াদেশ দেবেন। অন্যদিকে দেশীয় আমদানিকারকরা আমদানির পণ্য খুঁজতে বিদেশ না গিয়ে মেলার মাধ্যমে সেই সুযোগ লুফে নেবেন। তবে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় এ দুটি উদ্দেশ্যের কোনোটির যথাযথ প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে দাবি ব্যবসায়ী ও মেলায় আসা দর্শনার্থীদের। মেলায় কোনো বিদেশি দর্শনার্থী বা পর্যটকও চোখে পড়ে না।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, এ বছর মেলায় অংশ নিয়েছে দেশি-বিদেশি মোট ৩৬১টি স্টল। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, হংকং, ইরান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান এই সাতটি দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠান মেলায় যুক্ত হয়েছে। গত আসরে মেলায় বিদেশি স্টলের সংখ্যা ছিল ৯টি। তবে ব্র্যান্ডের স্টলগুলোর চেয়ে বেশি চোখে পড়ে নিম্নমানের পণ্য ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান। এসব নিম্নমানের পণ্যের কারণে নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোও পড়েছে বিপাকে।
আরও জানা গেছে, ইপিবি প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে ৩০ থেকে ৩৫টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশ নেয়। তাদের মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশি সেসব মেলায় অংশ নেন। বিশ্বমানের অনেক মেলায় অংশ নিলেও নিজের দেশের মেলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে পারেনি ইপিবি।
চকবাজারের পণ্যে সয়লাব : মেলায় কয়েকটি দেশি স্টলে পোস্টার টানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বিদেশি পণ্য। আবার বিদেশি স্টলেও দেশি পণ্য বিক্রি হতে দেখা গেছে। মেলায় মিলছে চকবাজারের নিম্নমানের আচার, চকোলেট, জেলিসহ শিশুদের নানা খাবার। এসব দোকানে বিদেশি বিভিন্ন চকোলেট বিক্রি হলেও নেই কোনো আমদানিকারকের সিল ও পণ্যের মূল্য। চকবাজার থেকে আনা নকল প্রসাধনীতে নামিদামি ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। গৃহস্থালি পণ্যগুলোতেও বিভিন্ন নামিনামি ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে ছাড়ের নামে বিক্রি করা হয়। মেলায় পোশাক পণ্যেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। শাল, থ্রিপিস ও তাঁতের শাড়িগুলো ভারতীয়, পাকিস্তানি ও কাশ্মীরি বলে বিক্রি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে বেশির ভাগ কাপড় নরসিংদীর বাবুরহাট, গাউছিয়া ও ইসলামপুর থেকে কিনে এনে মেলায় উঠানো হয় বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এদিকে মেলায় দেশীয় পণ্যের নামিদামি ব্র্যান্ডের স্টলগুলো বিপাকে পড়েছে মানহীন পণ্যে সয়লাবের কারণে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যেসব প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে, মানহীন পণ্যের কারণে তারা সেভাবে ব্র্যান্ডিং করতে পারছে না বলে অভিযোগ কিছু ব্যবসায়ীর। রূপগঞ্জের রূপসী এলাকা থেকে নূর আলম আকাশ পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, বাণিজ্যমেলায় স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু মেলায় আন্তর্জাতিক পণ্যের চেয়ে চকবাজারের পণ্য বেশি।
যমুনার প্যাভিলিয়নে ক্রেতাদের ভিড় : মঙ্গলবার বাণিজ্যমেলায় যমুনার প্যাভিলিয়নে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। যমুনা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলস লিমিটেডের ম্যানেজার রাজিব সাহা বলেন, বিগত বছরের মতো এবারও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী মেলায় আমরা উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রাইসকুকার, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রনিক ওভেন, গ্যাস বার্নার, কারি-কুকার, ইনফ্রারেড কুকার, রুম-হিটার, ভেন্ডার, মিক্সারভেন্ডার, জুসার। এসব গৃহস্থালি পণ্য আমরা বিশেষ ছাড়ে বিক্রি করছি।
তিনি আরও বলেন, যমুনা ইলেকট্রনিক্সের রেফ্রিজারেটর (ডাবল ডোর ও সিঙ্গেল ডোর) বিশেষ মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। স্মার্ট টিভি ও গুগল টিভিসহ সব পণ্য যমুনার নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে তৈরির কারণে সহজে ও কম দামে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি আমরা।
পিতলগঞ্জ এলাকা থেকে মেলায় আসা গৃহবধূ পারুল জাহান বলেন, যমুনার গৃহস্থালি পণ্য সব সময়ই কেনা হয়। এগুলো টেকসই ও মজবুত। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা শিক্ষিকা আলো বেগম বলেন, যমুনার মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিনেছি। একটি ফ্রিজও বুকিং দিয়েছি। আগামী সপ্তাহে এসে নিয়ে যাব।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সচিব বিবেক সরকার বলেন, মেলায় নিম্নমানের পণ্য বেচাকেনা যাতে না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা হচ্ছে। যারা এসব বিক্রি করছে তাদের প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। না মানলে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।