রোববার   ১২ জানুয়ারি ২০২৫   পৌষ ২৮ ১৪৩১   ১২ রজব ১৪৪৬

ডিমের বাজারে তৎপর ৬০ ফড়িয়া

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:৩৫ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০২৫ রোববার

স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির বড় অংশ পূরণ করে মুরগির ডিম। দামের দিক থেকে মাছ-মাংসের চেয়ে অনেকটা সহজলভ্য ছিল। কিন্তু গেল দুবছর ধরে ডিমের বাজার অস্থিতিশীল। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে উদ্বৃত্ত থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ী, করপোরেট ও ফড়িয়া সিন্ডিকেটের কারণে দাম বেড়েছে। জানা গেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দেশের ডিমের বাজার অস্থিতিশীল করতে করপোরেট কোম্পানির পাশাপাশি ফড়িয়া সিন্ডিকেটের অন্তত ৬০ জন সদস্য সক্রিয় ছিলেন। মূলত তারাই ডিমের বাজার বেসামাল করে তোলেন।

জানা গেছে, ফড়িয়া সিন্ডিকেটের ৬০ সদস্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের ১১ জন, নারায়ণগঞ্জের ৫, মুন্সীগঞ্জের ৪, চাঁদপুরের ২, মাওনা ৫, গাজীপুর ৮, ময়মনসিংহের ১০, টাঙ্গাইলের ৫ ও ঢাকার ১০ জন ব্যবসায়ী জড়িত। এসব সদস্য যখনই সক্রিয় হয় তখনই বাজারে সংকট দেখা দেয়।

কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে ডিমের উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ পিস। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। এ হিসাবে চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত থাকছে ৩০ শতাংশ। অথচ ব্যবসায়ীরা উৎপাদনের সংকট দেখিয়ে গেল দুবছর ধরেই ডিমের দাম বাড়িয়েছে।

খবর নিয়ে জানা গেছে, পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রির করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরেও দেশের সব থেকে বেশি ডিম উৎপাদনকারী এলাকাগুলোয় সক্রিয় ফড়িয়া সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মূলত ডিম উৎপাদনের শীর্ষস্থানীয় গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, উত্তরাঞ্চল ও চট্টগ্রামের ফড়িয়াদের খুদেবার্তায় ডিমের দাম বেড়ে যায়।

দেশের বাজারে গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ডিমের দামে রেকর্ড গড়েছে। প্রতি ডজন ডিম ১৮০ টাকায় কিনতে হয়েছিল ভোক্তাদের। ডিমের দাম কমাতে সরকার গত ১৯ নভেম্বর প্রায় ১৯ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দেয়। এতে বাজারে ডিমের দামে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। প্রকারভেদে প্রতি ডজন ডিম ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অসাধু ব্যবসায়ী এবং ফড়িয়া সিন্ডিকেটকে কঠিন নজরদারিতে রাখার কথা বলছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের মানুষের আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর সহজলভ্য উপায় ডিম। মানুষের ডিমে নির্ভরতাকে পুঁজি করে এই পণ্যটির বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে করপোরেট কোম্পানি ও ফড়িয়া সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উচিত পোলট্রি ও ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাজারে নজরদারি বাড়ানো। যাতে উৎপাদনকারী থেকে ডিম সংগ্রহ করে ভোক্তাপর্যায়ে ভোগান্তি না বাড়াতে পারেন এসব ডিম সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

এ বিষয়ে রাজধানীর ডিমের বড় পাইকারি বাজার তেজগাঁও ডিমের আড়ত মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আমানত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশব্যাপী ডিম সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্যরা রয়েছেন। তারাই মূলত ডিমের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে। প্রথমত খামারিদের থেকে স্বল্প দামে ডিম ক্রয় করে হিমাগারে মজুদ করে বাজারে চাপ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় ধাপে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে খামারিদের থেকে কৌশলে তারা ডিম সংগ্রহ করে নেয়। তৃতীয় ধাপে এসব ডিম রাজধানীর ১০ পয়েন্টে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দেশের বড় পাইকারি ডিমের আড়তগুলোয় যেমন ডিমের সংকট পড়ে, তেমনি দৈনিক চাহিদার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ডিম সরবরাহ হয়ে থাকে। এতে করে বাজারে হাহাকার সৃষ্টি হয়।

বিশ্বে ডিম উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে চীন। এরপরই শীর্ষ দশের অন্য দেশগুলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল, রাশিয়া, জাপান, তুরস্ক ও পাকিস্তান। ২০২১ সালে বিশ্বে ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম। কিন্তু ডিম ভোগে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। তবে ২০২১-এর পর থেকে ডিমের উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী হলে ডিমের বাজার প্রায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এর জন্য দেশের শীর্ষ ডিম উৎপাদনকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করছেন ডিম ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, শীর্ষস্থানীয় ডিম উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো মূলত বাজারে অস্থিরতা বাড়ায়। এসব কোম্পানি তাদের প্রতিনিধিদের দিয়ে মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ডিমের দাম নির্ধারণ করে।

তেজগাঁও ডিমের আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারের একান্ত সদিচ্ছাই পোলট্রির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে এর আগে খাদ্য ও মেডিসিনের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাছাড়া যে হারে খরচ বাড়ছে সরকার বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে প্রান্তিক খামারিরা বেশি দিন আর পোলট্রি উৎপাদনের সঙ্গে থাকতে পারবেন না।

করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুরগির বাচ্চা বিক্রি ডিমের দাম বাড়ার বড় ব্যবধান গড়ে দেয় দাবি করে তিনি বলেন, বাজারে যখন ডিমের দাম বাড়ে তখনই গণমাধ্যমসহ সরকারের নানা সংস্থা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ডিমের আড়তগুলোয়। কিন্তু এর আগের যে প্রক্রিয়াগুলো থাকে তাতে সরকার যেন শিথিল থাকে। বিশেষ করে বাচ্চা উৎপাদন খরচ ও বিক্রির যে পার্থক্য থাকে তা মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি খোলাসা করা দরকার।

দেশে ডিমের উৎপাদন সংকট না থাকলেও এর আগে ২০২৩ সালে কোনো কারণ ছাড়াই আগস্ট মাসে ডিমের দাম বেড়েছিল। তখনো প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হয়েছিল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক ডিমের চাহিদা পাঁচ কোটি পিস। সে হিসাবে প্রতি মাসে ১৫০ কোটি পিস এবং বার্ষিক হিসাবে ১ হাজার ৮০০ কোটি পিস ডিমের চাহিদা রয়েছে। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি রয়েছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিমের বাজারে যে কারসাজি চলছে তা বন্ধ করতে হলে প্রথমে গঞ্জের খামারিদের টিকে থাকার সঙ্গী হতে হবে সরকারকে। আর তারা একবার সক্রিয় হয়ে গেলে বাজারের সিন্ডিকেট সদস্যরা নিজেরাই কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।

তিনি আরও বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যেমনটা উৎপাদনের ক্ষেত্রে জড়িত রয়েছে। তেমনি বিপণনের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা থাকা অত্যন্ত বেশি জরুরি। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও প্রতিযোগিতা কমিশন একযোগে কাজ করলে দেশব্যাপী যে সক্রিয় ডিমের ফড়িয়া সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের থামানো সম্ভব বলে আমরা মনে করছি। তাছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও তাদের সহযোগী সদস্য এবং দেশব্যাপী ডিমের যে সক্রিয় ফড়িয়া সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের প্রতি সরকার নজরদারি বাড়ালে ভবিষ্যতে ডিম কিংবা পোলট্রির বাজারে আর অস্থিরতা সৃষ্টি হবে না।