বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫   মাঘ ২ ১৪৩১   ১৫ রজব ১৪৪৬

পরিত্যক্ত বিমানবন্দর চালুর তোড়জোড়

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৪০ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার

  • বগুড়া বিমানবন্দরের ব্যয় হবে ১২০০ কোটি টাকা
  • এক বছরে কমপক্ষে ৩টি বিমানবন্দর চালুর চেষ্টা
  • অচল সব বিমানবন্দরের জায়গা দখল হয়ে গেছে
  • বিমানবন্দর সচল হলে চাঙ্গা হবে অর্থনীতি

 


অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করার জন্য দেশের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। দীর্ঘদিন ধরে ছয়টি বিমানবন্দর অকেজো রয়েছে। এসবের একটি বিমানবন্দর চালু করতে মন্ত্রণালয় ও বেবিচক দফায় দফায় বৈঠক করছে। বিমানবন্দর চালুর তোড়জোড় শুরু করেছে। অর্থ বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে বগুড়া বিমানবন্দর চালু করার চিন্তাভাবনা করছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়েছে।

আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত তিনটি বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করছে বেবিচক। পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের পাশাপাশি বরিশাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট বাড়াতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার এস্টারের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকও করা হয়েছে বলে একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, আকাশপথের যাত্রা বেড়ে গেছে। সড়কপথে যানজটের বিড়ম্বনা এড়াতেই আকাশপথে যাতায়াতের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে অ্যাভিয়েশন খাত লাভজনক হয়ে উঠছে। আকাশপথের প্রতিটি রুটেই যাত্রীদের চাহিদা থাকায় টিকিট পাওয়া যায় না। বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত, সিলেটের ওসমানী, কক্সবাজার, যশোর, সৈয়দপুর, বরিশাল ও রাজশাহী বিমানবন্দর দিয়ে বিমান চলাচল করছে।

দেশের ছয়টি বিমানবন্দর অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে অকেজো এগুলো। কোনো কোনো বিমানবন্দরে গরু-ছাগল চরানো হচ্ছে। কোনোটিতে গরুর ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি অব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রতিবেদনটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। বিমানবন্দরগুলোর সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বেবিচক। কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা নিরূপণের কাজ প্রায় শেষ।

অকেজো বিমানবন্দরগুলো হলো— পাবনার ঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁও, মৌলভীবাজারের শমশেরনগর, কুমিল্লা, বগুড়া ও লালমনিরহাট। ব্রিটিশ আমলে এগুলো তৈরি করা হয়। এরই মধ্যে কয়েকটি বিমানবন্দর চালু হলেও সেগুলো আবার বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। আবার বিমানবন্দরগুলো সচল করতে বিভিন্ন মহল থেকে জোরালো দাবি উঠেছে।

মাসখানেক আগে বগুড়া বিমানবন্দর চালু করতে বিশেষ একটি বৈঠক হয়েছে বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ে। এর জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো আবার চালু করতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। প্রথমে প্রাধান্য দিচ্ছি বগুড়া বিমানবন্দর চালু করতে। সেটি কী অবস্থায় আছে, তা পর্যালোচনা করতে আমরা সরেজমিনে গিয়েছি। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে বিমানবন্দরটির সংস্কার কার্যক্রম চালু করতে পারব। এটি চালু করতে পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে।’

বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের জায়গা প্রভাবশালী মহল দখল করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে। কেউ কেউ বসতভিটা তৈরি করে বসবাস করছে। সংশ্লিষ্টদের উচ্ছেদ করতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো দ্রুত সময়ে চালু করতে আমরা তোড়জোড় শুরু করেছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করতে সরকারও চাচ্ছে বিমানবন্দরগুলো আবার চালু করতে। আশা করি, আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত তিনটি বিমানবন্দর চালু করা সম্ভব হবে। মাস দু-এক আগে সরকারের কাছে বাজেট চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

বেবিচক সূত্র জানায়, প্রায় দুই যুগ ধরে অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে আছে বিএনপি আমলে নির্মিত বগুড়া বিমানবন্দর। এটি আবার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চালুর সম্ভাব্য যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকমানের এ বিমানবন্দর নির্মাণের পর ২৪ বছরেও চালু হয়নি। রাজস্ব আয় বাড়ানো ও দেশি-বিদেশি যাত্রীদের সুবিধার্থে বিমানবন্দরটি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত রবিবার বিমানবাহিনীপ্রধান ও বেবিচক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা বগুড়া বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন। শুরুতে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চালুর কথা ভেবেছিলেন তারা। এখন অতিরিক্ত ৫৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে বেবিচক। বগুড়া বিমানবন্দর করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। নানা জটিলতায় সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে।

১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকার সেখানে বিমানবন্দর স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করে। ১৯৯৫ সালে সদর উপজেলার এরুলিয়ায় বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে ১০৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রানওয়ে, কার্যালয় ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০০০ সালে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশি পর্যটক বগুড়ায় আসা-যাওয়া করেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানগড়সহ একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে সেখানে। সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় প্রায় ২০টি শিল্পকারখানা রয়েছে। তার মধ্যে এসেনশিয়াল ড্রাগস, ওয়ান ফার্মাসিউটিক্যালস, ট্রান্সকম কনজ্যুমার প্রোডাক্ট, উত্তরা মোটরস ও এবিসি টাইলস উল্লেখযোগ্য। বগুড়ায় চার তারকা হোটেল রয়েছে দুটি। বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালুর মতো সব ধরনের অনুক‚ল পরিবেশ আছে সেখানে।

পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলোর অবস্থা এখন কী রকম, তা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন বেবিচক কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলোর দুটিতে একটি বাহিনীর গরুর ফার্ম রয়েছে। অন্যগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। কয়েকটিতে গরু-ছাগল লালনপালন করা হয়। সব কটি বিমানবন্দরই আবার সক্রিয় করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে।

১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এখান থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করলেও, পরের বছরই তা বন্ধ হয়ে যায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ঈশ্বরদী বিমানবন্দরকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

১৯৯৫ সালে অ্যারো বেঙ্গল এয়ার সার্ভিস মৌলভীবাজারের শমশেরনগর বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট চালু করলেও যাত্রীর অভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের মানুষদের বিমানে যাতায়াত করতে সিলেট বিমানবন্দরে যেতে হয়। এতে সময় লাগে বেশি। শমশেরনগর বিমানবন্দর চালু হলে তারা উপকৃত হবেন। নেউরা-ঢুলিপাড়ার পাশে কুমিল্লা বিমানবন্দর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটে সচল ছিল। ১৯৯৪ সালে আবার ফ্লাইট চালু হলেও যাত্রীসংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বিমানবন্দর-সংলগ্ন ইপিজেড রয়েছে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ১৯৮০ সাল থেকে ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর অচল।

আশির দশকের পর লালমনিরহাট বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল করেনি। বাগেরহাটের খান জাহান আলী বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে একনেকে এসবের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বরাদ্দ করা হয় ৫৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু চারপাশের দেয়াল নির্মাণ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। ২০১৮ সালের জুন মাসে কাজ শেষ করার কথা ছিল।

বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে খুলনার মূল শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ফুলতলার মশিয়ালীতে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৯৬৮ সালে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে খুলনা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে বিল ডাকাতিয়ার তেলিগাতিতে স্থান নির্বাচন ও জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরে সেই জমি বাতিল করে আশির দশকে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালীতে স্থান নির্ধারণ করা হয়। এরশাদ সরকারের আমলে খুলনা-মোংলা মহাসড়কের ওপর স্লট বিমান নামানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে ৯৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বাগেরহাটের রামপালে খানজাহান আলী বিমানবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

তিনি বলেন, ২০১১ সালের ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর করার ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর নতুন করে আরও ৫৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ৫৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। মাস দু-এক আগে বিমানবন্দরের কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।