বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫   মাঘ ২ ১৪৩১   ১৫ রজব ১৪৪৬

বিপু-ববির ভাই-বন্ধুদের দখলে বাণিজ্য

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৪৬ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার

বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার

► বাজারদরের চেয়ে বেশি আমদানি মূল্য দেখিয়ে টাকা পাচার
► দরপত্র ছাড়াই বিভিন্ন সংস্থায় সরাসরি সরবরাহ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার বাণিজ্যের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির ভাই-বন্ধুরা। এর মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল এ হেভিওয়েটদের কাছে। ভিআইপি এ সিন্ডিকেট উৎপাদনের বদলে প্রিপেইড মিটার আমদানি করে মিটার সরবরাহ করেছিল। তারা বাজারদরের চেয়ে বেশি আমদানি মূল্য দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে। আবার দরপত্র ছাড়াই বিভিন্ন সংস্থায় সরাসরি মিটার সরবরাহের সুযোগ নেয়। মূলত প্রিপেইড মিটারের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা এবং সেখানে বাইরের কারও অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। বলা যায়, বিপু-ববির ভাই-বন্ধুরা তাই একচেটিয়া প্রিপেইড মিটারের বাণিজ্য নিজেদের হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানায়, এ খাতে ভবিষ্যতে যাতে আর বাণিজ্য ও দুর্নীতি না হয় এজন্য খাতটির উন্মুক্ত দরপত্রের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এতে আগ্রহী সব প্রতিষ্ঠান সামনে দরপত্র অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রিপেইড মিটার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গোষ্ঠীবিশেষের অবৈধ উপায়ে অর্থ আয়ের বাজার তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র এর মাধ্যমে লুণ্ঠনমূলক বাণিজ্য পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করেছিল। এ খাতে মিটার বাণিজ্যের মাধ্যমে কত টাকা লুট করা হয়েছে সেটি নির্ধারণ করে আদায় করতে হবে এবং এ কাজে জড়িতদের সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রিপেইড মিটারে সিন্ডিকেট ভাঙতে আমরা এই খাতটির জন্য উন্মুক্ত দরপত্রের ব্যবস্থা করে দেব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রিপেইড মিটার স্থাপনের জন্য কিছু মিটার সরাসরি ক্রয় করা হয়। আর কিছু উন্মুক্ত দরপত্র ডাকা হলেও চূড়ান্ত ঠিকাদার ঠিক করতেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। চীনের তিনটি কোম্পানি- সেনজেন স্টার, হেক্সিং এবং ওয়াসিয়ন গ্রুপ একটি চক্রে যুক্ত হয়ে সব মিটার সরবরাহ করে। মিটার বাণিজ্যের নামে টাকা পাচারের অভিযোগ আছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৯ সালে নেসকোতে মিটার সরবরাহের কাজ পায় ‘অকুলিন টেক’ নামের একটি কোম্পানি। চীনের সেনজেন স্টারের সঙ্গে যৌথভাবে ১০৭ কোটি টাকার কাজ পায় তারা। এরপর ২০২১ সালে তারা আবার নেসকোতে প্রায় ৯২ কোটি টাকার কাজ পায়। আর নেসকোতে কাজের অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে মিটার সরবরাহের কাজ নেয় অকুলিন। এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সে সময়ের বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউস চাপ প্রয়োগ করেন নেসকো বোর্ডকে।

অকুলিন টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন শাবাদ সাজিদ। এ কোম্পানির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে হংকং থেকে যোগ দেন কে রুম্মান আখতার। তারা দুজন হলেন- শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বন্ধু। অকুলিন মূলত মিটার ব্যবহারের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সফটওয়্যার সরবরাহের কাজ নেয়। এর মাধ্যমে তারা দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করে। এর বাইরে কেউ অংশ নিতে চাইলেও তাকে ভয় দেখিয়ে আটকানোর কাজ করতেন নসরুল হামিদ।

সাতটি দরপত্রের মাধ্যমে মিটার সরবরাহের কাজ দেয় নেসকো। এর মধ্যে কোনো দরপত্রে দুটির বেশি কোম্পানি অংশ নেয়নি। চারটি দরপত্রে সাড়ে ৫০০ কোটির টাকার কাজ পেয়েছে চীনের সেনজেন স্টার আর তিনটিতে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ওয়াসিয়ন। সেনজেন স্টারের সঙ্গে দুটিতে অংশীদার ছিল অকুলিন আর দুটিতে ছিল মিটার ডি টেক। সেনজেন স্টারের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন নসরুল হামিদের স্ত্রীর বড় ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ সুজাত ইসলাম। তার মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব নেন তার কাছের আত্মীয় মাহবুব রহমান ওরফে তরুণ। ওয়াসিয়নের সঙ্গে দুটিতে ছিল টেকনো ইলেকট্রিক্যাল ও একটিতে ছিল এসকিউ ট্রেডিং। এই তিন কোম্পানি এসকিউ গ্রুপের যার মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন ওরফে শামীম। ওয়াসিয়নের স্থানীয় প্রতিনিধি হলো এসকিউ। মিটার বাণিজ্যের জন্য আরইবিকে টার্গেট করেছিল চক্রটি। ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক আরইবির। এ পর্যন্ত ১৭ লাখ মিটার বসানো হয়েছে। আরও ৫ লাখ ৬০ হাজারের কাজ চলছে। আরইবি ৫ লাখ স্মার্ট প্রিপেইড মিটার কিনতে ২০২২ সালে দরপত্র আহ্বান করে। এখানেও দুটি দরপ্রস্তাব জমা পড়ে। দুটিই শামীমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে যৌথভাবে কাজ পায় অকুলিন টেক ও শামীমের এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেবলস। দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য কোম্পানি ভিকার ইন্টারন্যাশনাল হলো আওয়ামী লীগের আরেক সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের ভাই নাজমুল হকের। মিটার ও কমিউনিকেশন সিস্টেম সরবরাহের নামে ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা দর দিয়ে যৌথভাবে কাজটি পায় অকুলিন ও এসকিউ। এতে প্রতিযোগিতামূলক দামের চেয়ে অন্তত ৬১৭ কোটি টাকা বাড়তি নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। যদিও এ প্রকল্পে মিটার সরবরাহের কাজ এখনো শুরু হয়নি।