যেসব কারণে বেড়েছে প্লেনের টিকিটের দাম
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১০ এএম, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ সোমবার
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে বিমানের টিকিটের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক আলোচনা চলছে। টিকিটের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আরোপিত মাত্রাতিরিক্ত ট্রাভেল ট্যাক্স, এক্সাইজ ডিউটি, পদ্মা অয়েলের অস্বাভাবিক জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি, সিভিল এভিয়েশনের আকাশচুম্বি ল্যান্ডিং-পার্কিং ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একক আধিপত্যে থাকা অতিরিক্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ টিকিটের এই দামবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
এনবিআরের মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স, এক্সাইজ ডিউটির বৃদ্ধির প্রভাব টিকিটে
এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, বাংলাদেশ থেকে একটি প্লেনের টিকিটে এনবিআর থেকে যে পরিমাণ ট্রাভেল ট্যাক্স এবং এক্সাইজ ডিউটি নেয় তা দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যর বিমানবন্দরের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।
ঢাকা থেকে বর্তমানে সিঙ্গাপুর, দুবাই, ওমান, শারজাহ, কুয়ালালামপুর এই পাঁচটি রুটের টিকিট কাটলে যাত্রীপ্রতি বাংলাদেশ সরকার ৯ হাজার ৮৯০ ট্যাক্স আদায় করে। অথচ একই রুটে মালয়েশিয়ার সরকার ট্যাক্স নেয় ২ হাজার ৫৬৮ টাকা, সিঙ্গাপুর ৫ হাজার ৮৭৮, ওমান ৩ হাজার ৮৭৯, দুবাই ও শারজাহ নেয় ৪ হাজার ৩৩২ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে একজন যাত্রী এই পাঁচটি রুটে যাত্রা করলে করলে তাকে ৭ হাজার টাকা বেশি ট্যাক্স দিতে হচ্ছে।
টিকিটের দামের সঙ্গে এনবিআর যেসব ট্যাক্স আদায় করে তারমধ্যে ট্রাভেল ট্যাক্স ৪ হাজার এবং এক্সাইজ ডিউটি ২৫০০ টাকা।
২০২৩ সালের আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের টিকিটে যাত্রীর কাছ থেকে কোনো ট্রাভেল ট্যাক্স নেওয়া হতো না। তবে প্রথমে এটি ২০০ টাকা নির্ধারণ করে পরবর্তী সময়ে এই ট্যাক্স দিগুণ করে বর্তমানে ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া সার্কভুক্ত দেশে ভ্রমণের টিকিটের সঙ্গে বর্তমানে ২ হাজার টাকা ভ্রমণ কর নেওয়া হচ্ছে, যা আগে ১২০০ টাকা ছিল। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এই ট্রাভেল ট্যাক্স প্রায় দিগুণ বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে; যা যাত্রীর টিকিটের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়।
২০২৪ সালেও একটি টিকিটের সঙ্গে ৫০০ টাকা এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক আদায় করতো এনবিআর। বর্তমানে সার্কভুক্ত দেশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক ১০০০ এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে ২৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া বর্তমানে একটি টিকিটের সঙ্গে যাত্রীকে এম্বারকেশন ফি ৫০০ টাকা, এয়ারপোর্ট উন্নয়ন ফি ১০ মার্কির ডলার, যাত্রী নিরাপত্তা জন্য ১০ মার্কিন ডলার, ভ্যাট ৩ ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে।
অতিরিক্ত দামে পদ্মা অয়েলের জেট ফুয়েল
দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, বাংলাদেশে প্লেন টিকিটের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ জেট ফুয়েলের দাম। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আওতাধীন পদ্মা অয়েল কোম্পানি একমাত্র জেট ফুয়েল আমদানি ও বিক্রি করে। তারা নিজেদের মতো করে মনোপলি বা একচেটিয়াভাবে দাম বাড়ায়। জানুয়ারিতে প্রতি লিটার জেট ফুয়েল কিনতে হয়েছে দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলারে। অথচ একই তেল ভারতের চেন্নাইয়ে দশমিক ৬৩ মার্কিন ডলার, দুবাই ৫৮, শারজাহ ৬৪, চীনের গুয়াংজু-তে ৫৪, কুয়ালালামপুর ৫৯ ও জেদ্দা দশমিক ৫৭ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়।
বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের একটা বিমান ঢাকা অবতরণ করলে ১৫৪০ মার্কিন ডলার ও তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, যা বাংলাদশি টাকায় প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার টাকা। অথচ একই বিমান মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর নামলে তাকে মাত্রা ১৫ হাজার ৫৩৭ টাকা ল্যান্ডিং চার্জ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ একই বিমান ঢাকায় নামলে মালয়েশিয়ার চেয়ে ২ লাখ ৭ হাজার টাকা বেশি চার্জ দিতে হয়
একজন যাত্রীকে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের একটি বিমানে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর নিতে ১০৩ লিটার তেল খরচ হয়। তেলের দাম বাড়ার কারণে যাত্রীপ্রতি অতিরিক্ত খরচ বেড়েছে ২ হাজার ১৬ টাকা, যা একজন যাত্রীর টিকিটের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সর মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি এয়ারলাইন্সের যে কোনো রুটের ৫০ শতাংশের বেশি পরিচালন ব্যয় (অপারেশন কস্ট) হচ্ছে ফুয়েলের দাম। গত কয়েকবছরে জেট ফুয়েলের দামবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন রুটে যাত্রীপ্রতি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বাড়তি তেল খরচ যাত্রীর টিকিটের দামে যুক্ত হওয়ার কারণে টিকেটের দাম কিছুটা বাড়ছে।
আকাশচুম্বী ল্যান্ডিং-পার্কিং ও এয়ার নেভিগেশন চার্জ
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো থেকে যে ল্যান্ডিং-পার্কি চার্জ আদায় করা হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এতে যে কোনো এয়ারলাইন্স ঢাকায় বিমানবন্দরে উঠা-নামা ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে।
এয়ারলাইন্সগুলো জানায়, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের একটা বিমান ঢাকা অবতরণ করলে ১৫৪০ মার্কিন ডলার ও তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, যা বাংলাদশি টাকায় প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার টাকা। অথচ একই বিমান মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর নামলে তাকে মাত্রা ১৫ হাজার ৫৩৭ টাকা ল্যান্ডিং চার্জ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ একই বিমান ঢাকায় নামলে মালয়েশিয়ার চেয়ে ২ লাখ ৭ হাজার টাকা বেশি চার্জ দিতে হয়। এই আকাশচুম্বী চার্জ যাত্রীদের টিকিটের দামে প্রভাব ফেলছে।
টিকিটের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় এভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টদের সংগঠন এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ, ল্যান্ডিং-পার্কিং চার্জসহ সবগুলো চার্জই বেশি। চার্জগুলো বেশি হলে ভাড়া বেশি হবে না কেন?
তিনি বলেন, প্লেনের টিকিটে সরকারি ট্যাক্সগুলো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ট্যাক্সের বোঝা যাত্রীর ওপর পড়ছে। আমরা এসব বিষয়ে অনেক সময় আলোচনায় বলেছি। তবে যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাদের ভাষ্য হচ্ছে, আকাশপথের যাত্রীরা (স্বচ্ছল) এসব ট্যাক্স বহন করতে পারবেন। অথচ আমাদের ৮০ শতাংশ যাত্রীই দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কর্মজীবী শ্রমিক।
তিনি বলেন, টিকিটের ওপর কর আরোপ করা যেতেই পারে, তবে এটা যাত্রীদের জন্য সহনীয় হতে হবে। মালয়েশিয়ার মতো একটি রুটে যেখানে ভাড়া ৪০ হাজার টাকা, সেখানে ১৫ হাজার টাকার ট্যাক্স ও ফি আরোপ করা কোনভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
অস্বাভাবিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ, বিমানের মনোপলি
দেশীয় ও বিদেশি সব এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের পর পথ দেখিয়ে পার্কিং বে-তে নেওয়া, দরজায় সিঁড়ি লাগানো, যাত্রীদের মালামাল ওঠানো-নামানো, কার্গো লোড-আনলোড, উড়োজাহাজের ভেতর পরিষ্কার করা, চেকইন কাউন্টারে সেবার মতো ইত্যাদি গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের মধ্যে পড়ে। এসব কাজের জন্য বিমান বংলাদেশ এয়ারলাইন্স যে চার্জ নিচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বেশি।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বোয়িং ৭৩৮-৮০০ মডেলে বিমানের ফ্লাইটের জন্য বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ নিচ্ছে ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার বা ৩ লাখ ৬ হাজার টাকা। অথচ মালয়েশিয়া পৃথিবীর অন্যতম একটি বড় বিমানবন্দর। সেখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ মাত্র সাড়ে ৩ হাজার রিঙ্গিত বা ৯৭ হাজার ৫৪৫ টাকা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের রাজস্বের একটি বড় অংশ আসে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে চার্জগুলো অনেক প্রতিযোগিতামূলক হয়। তবে দেশের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে বিমানের একক আধিপত্য বিস্তার করছে। নিজেদের রাজস্ব ধরে রাখতে তারা ইচ্ছেমতো রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ নির্ধারণ করেছে; যা যাত্রীদের টিকিটের দামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই সময়টাতে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোতে টিকিটের চাহিদা বেশি থাকে। সিটের তুলনায় যাত্রী বেশি থাকায় টিকিটের দাম বাড়তে পারে। সরকারের ট্রাভেল ট্যাক্স বৃদ্ধি, ল্যান্ডিং চার্জ, অতিরিক্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জও দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি অনেক এজেন্সি যাত্রী চাহিদার সুযোগ নিয়ে বাল্ক টিকিট কিনে রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ায়।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রতি মার্কিন ডলারের দর ছিল ১০২ টাকা, বর্তমানে তা ১২২ টাকা। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে সব চার্জ মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হয়, সেক্ষেত্রে টাকার এই অবমূল্যায়নও টিকিটের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
সময়মতো পেমেন্ট না পেয়ে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে বিদেশি এয়ারলাইন্স
প্লেনের টিকিটের দাম বাড়ার অন্য আরেকটি কারণ হলো ডলার সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোতে সময়মত পেমেন্ট করতে না পারা। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আয়াটা) তথ্যমতে, এখনও বিদেশি এয়াররাইন্সগুলো বাংলাদেশের কাছে ১৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ১৯ কোটি টাকা বকেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সময়মতো রেমিট না পাওয়ায় এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশের টিকিট বিক্রি করতে অনুৎসাহিত হচ্ছে। তারা বাংলাদেশ থেকে টিকিটের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অর্থাৎ টিকিটগুলো অন্যান্য দেশ থেকে কাটতে যত ভাড়া দিতে হয়, বাংলাদেশ থেকে কাটলে অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ আদায় করছে।
ডলারের দামবৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন
দেশের প্লেনের টিকিট বৃদ্ধির আরেক কারণ গত ২ বছরে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়ন। ২ বছর আগে অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রতি মার্কিন ডলারের দর ছিল ১০২ টাকা, বর্তমানে তা ১২২ টাকা। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে সব চার্জ মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হয়, সেক্ষেত্রে টাকার এই অবমূল্যায়নও টিকিটের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী।