আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৫০%
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৯:০৬ এএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ বৃহস্পতিবার
অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি, ব্যাংকের তারল্য সংকটসহ নানা অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থা দাঁড়ায়। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কাটাতে গেল তিন বছরে অতিরিক্ত অর্থ ছাপানোয় বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি, কমেছে টাকার মান। এতে বৈদেশিক মুদ্রার দাম তর তর করে বাড়তে থাকে।
এদিকে টাকার বিপরীতে ডলার মান বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় আমদানি নির্ভর পণ্যের দামও হু হু করে বেড়েছে। তাতে দেশের মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় দ্বিগুণ বেড়েছে। অনেকে বাধ্য হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবহার কমিয়েছে। সব মিলিয়ে গেত তিন বছরে ডলার সংকটসহ নানা জটিলতায় দেশের আমদানি খাতের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এমন পরিস্থিতি অতিরিক্ত দামে পণ্য কিনে তা বাজারজাত করতে না পারায় আশঙ্কাজনক হারে কমেছে আমদানিকারক। তাতে দেশের ভোগ্যপণ্যের মজুদ সংকটে পড়বে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বাড়লে পণ্য আমদানি করে মানুষের চাহিদা মেটায় সরকার। এর জন্য ভিন্ন ভিন্ন কারণে পণ্য আমদানি করতে হয়। তবে মুদ্রাস্ফীতির আমদানিকৃত পণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশের মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ার বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে আগামীতে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের সংকট বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় মানুষ যে কষ্টে আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায় আমাদের এই সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা করতে হবে। পাশাপাশি স্থির কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। যাতে মানুষের আয় বাড়ে।
এদিকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে রেকর্ড ঋণখেলাপি ও নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদানে দেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ।
সরকারের তথ্যানুসারে গত বছর চাল, চিনি, মসলা, গম, দুগ্ধজাত পণ্য, তুলাসহ অন্তত ১০টি ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, যা গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরের থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশিতে অর্থাৎ ৬৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এরপরের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করতে হয়েছে। এর পরের বছর ২৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয়ে ৯৫ হাজার ৯০২ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে লাগাতার চিনি, তুলা, দুগ্ধজাত পণ্য ও মরিচসহ অন্তত সাতটি পণ্যের আমদানি বেড়েছে সব থেকে বেশি।
এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব থেকে বেশি তুলা আমদানি হয়েছিল ২২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার, গম আমদানি ১২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, বীজ ৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, সার ৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর পরের বছরগুলোয় ক্রমান্বয়ে এসব পণ্যের আমদানি খরচ বেড়েই চলেছে।
ক্রমান্বয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার সার, ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার চিনি, ৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার ডাল, ২৮ হাজার ২২৩ কোটি টাকার ভোগ্যপণ্য, ১২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার তৈলবীজ ও ১৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকার গম আমদানি করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, চাহিদার তুলনায় দেশে ভোগ্যপণ্যের জোগান কম, দুর্যোগ পরিস্থিতিতে উৎপাদন ব্যাহতসহ নানা কারণে খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের টাকার বিপরীতে যেহেতু ডলার দাম বেশি, তাই আমদানিকৃত পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রাখতে উৎপাদন না বাড়ালে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হবে। তবে আমাদের উচিত হবে, যেন পণ্য আমদানি কমিয়ে উৎপাদনমুখী হতে পারি।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়তি থাকায় অনেক ছোট ব্যবসায়ী আমদানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমাননা হওয়ায় পণ্য আমদানি ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে যুদ্ধ ও বৈশি^ক নানা দুর্যোগ থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়তি থাকায় দেশের বাজারে এর প্রকটা প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি এলসি জটিলতাসহ সব মিলিয়ে অনেক ছোট ছোট আমদানিকারক তাদের আমদানির সক্ষমতা হারিয়েছেন।
এ বিষয়ে টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনার পরিচালক সাইফুল আতাহার দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগে ৮৫ টাকা খরচ করে প্রতি ডলার কেনা যেত। কিন্তু ডলারের দাম প্রতিযোগিতা দিয়ে বাড়তে বাড়তে তা এখন দাঁড়িয়েছে ১২৪-১২৫ টাকায়, যা গাণিতিক হিসেবে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়তি।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় দেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা গিয়েছে। তার ওপর ৫০ শতাংশ বেশি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করে অনেক কোম্পানি সেই পণ্য মার্কেটে সেল করতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়েছে। তাতে বহু ছোট ও মাঝারি মানের কোম্পানি পণ্য আমদানির সক্ষমতা হারিয়েছে।