শুক্রবার   ৩১ জানুয়ারি ২০২৫   মাঘ ১৭ ১৪৩১   ০১ শা'বান ১৪৪৬

রোজার আগেই পকেট কাটার আয়োজন!

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১০:০১ এএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ বৃহস্পতিবার

রমজান আসতে আর বাকি এক মাসের কিছুটা বেশি সময়। বরাবরের মতো এবার রোজার আগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। বিশেষ করে সেহরি ও ইফতারে ব্যবহৃত পণ্যগুলো রোজা আসার আগে আগেই দাম বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রমজানের আরও এক মাস সময় থাকতেই বেড়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। এতে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তদের চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিভিন্ন সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় এবার ইফতারে ফলের আয়োজন কমিয়ে দিতে হবে অনেককে। তবে চিনি ও পেঁয়াজের দাম কমেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন ফলের আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে ১০ শতাংশ। এতে এসব ফলেরও দামে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশে এখনো ডলারের তীব্র সংকট বিদ্যমান। সেইসঙ্গে রিজার্ভের ক্ষয়ও অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকগুলোয় ডলার মিলছে না বাড়তি দামেও। ফলে অতি জরুরি পণ্যও চাহিদামাফিক আমদানি করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই আমদানি কমিয়েছেন তারা, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে পণ্যের মজুতের ওপর। এ কারণে সামনে রমজান ঘিরে এসব পণ্যের চাহিদা, মজুত ও সম্ভাব্য জোগানের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি অনেকেই বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
বিএনপির শরিকরা আসন নিয়ে বোঝাপড়ার প্রত্যাশায়

এদিকে, রোজায় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের একাধিক সংস্থা মাঠে থাকবে। সংস্থাগুলো হলো—বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিও থাকবে। এর পরও কারসাজির প্রমাণ মেললে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জরিমানার পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হবে। প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেওয়া হবে।

প্রশাসনের এমন কঠোর পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে নেই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রমজান মাসে যেখানে বিভিন্ন পণ্যের ওপর বিশাল ছাড় দেয়, সেখানে বাংলাদেশে রমজান এলেই এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেন ব্যবসায়ীরা। এতে একপক্ষ অন্যপক্ষকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কিছু করেন না তারা।

রোজা আসার আগেই বেড়ে গেছে বিভিন্ন ফলের দাম। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে ফুজি আপেল প্রতি কার্টনের (২০ কেজি) দাম ছিল ৫ হাজার টাকা, চলতি সপ্তাহে বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৪০০ টাকা। ভারত থেকে আমদানি করা কমলা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল প্রতি কার্টন ৪ হাজার ৫০০ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪০০ টাকায়। ৯ কেজি ওজনের প্রতি কার্টন আঙুরের দাম ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা, তা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার টাকা। চায়না কমলা বিক্রি হয়েছিল প্রতি কার্টন (৮-৯ কেজি) ৩ হাজার ১০০ টাকা, এখন তা ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাল্টা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কার্টন (১৪-১৫ কেজি) ৩ হাজার ৫০০ টাকা, যা আগে ছিল ৩ হাজার ১০০ টাকা।

পাঁচ কেজি ওজনের প্রতি কার্টন খেজুর ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সূত্রাপুরের ফল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, এক সপ্তাহ আগে এক কার্টন খেজুর কিনতে যা দাম দেওয়া লাগত, এখন সেই কার্টন কিনতে বেশি দিতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। আমাদেরই কিনতে হচ্ছে বাড়তি দাম দিয়ে। তাহলে তো আমরা কম বিক্রি করতে পারি না।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয় গলা বা বাংলা খেজুর। এ খেজুর গত বছরের শুরুতে বিক্রি হয়েছিল ২০০ টাকায়, যা এবার বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকায়। জাহিদি খেজুর গত বছরে বিক্রি হয়েছিল ২৪০-২৫০ টাকা কেজি। তা এবার বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকায়। জাম্বো মেডজুল মানভেদে গত বছর বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়, যা এবার বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। গত বছর সাধারণ মেডজুল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এবার তা ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আজওয়া পাওয়া যায় দুই ধরনের। বর্তমানে আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন চাল পাইকারিতে প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রতি বস্তা ব্রি-২৮ চাল ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায়। ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০ টাকার প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। স্বর্ণা ও পাইজাম চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকার মতো।

বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম: ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, রাজধানী ঢাকার বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৩ টাকায়, যা গত বছরের শুরুতে বিক্রি হয়েছিল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা প্রতি লিটার। পাম ওয়েল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা থেকে ১৫৮ টাকা, যা গত বছর ছিল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা লিটার। প্রতি কেজি মুগডাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১১০ থেকে ১২০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১২০ থেকে ১২৫ টাকা কেজি। ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৯৫-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট দানার মসুর ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৬২ থেকে ৭০ টাকা কেজি। চিনির দাম কিছুটা কমে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি।

পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও রসুনের দাম বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। রসুন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ২২০ টাকা কেজি। ছোট এলাচের দাম প্রায় ৬০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ টাকায়।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা: কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন কালবেলাকে বলেন, আমরা সব সময়ই দেখি রমজান এলেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীর। কিন্তু এবার আমরা ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছি। এবার রমজানের অনেক আগে থেকেই সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু এই এক মাস ব্যবসা করবে আর বাকি ১১ মাস বসে বসে খাবে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ফলের দাম এবারের রমজানে বাড়বে। তার অন্যতম কারণ সম্পূরক শুল্ক। আগে যেখানে সম্পূরক শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ, তা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। এর প্রভাব অবশ্যই পড়বে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান কালবেলাকে বলেন, বরাবরের মতো এবারও রোজায় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের একাধিক সংস্থা মাঠে থাকবে। আমরা শুধু রোজার সময়ই না, বরং সব সময়ই ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিতে মাঠে তৎপর রয়েছি।