অপরাধীরা প্রকাশ্যে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৩৩ এএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সোমবার

গুলির বিকট শব্দ। আর্তনাদ। মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া কিংবা পঙ্গুত্ববরণ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। পান থেকে চুন খসলেই ট্রিগারে টান দিচ্ছে অপরাধীরা। হঠাৎ করেই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধীরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাক পড়ছে কিশোর অপরাধীদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। নেপথ্য থেকে তাদের সার্বিক দেখভাল করছেন কুশীলবরা।
শুক্রবার ভোর রাত সাড়ে পাঁচটা। রাজধানীর পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের ১ নম্বর সড়কে পরপর পাঁচটি বুলেটের শব্দ। সঙ্গে গুলিবিদ্ধ মানুষের আর্তনাদ। শবেবরাতের নামাজ পড়ে ঘরে ফেরা মানুষ এগিয়ে গিয়ে দেখেন জসিম উদ্দিন (৪৪) ও তার ছোট বোন শাহিনুর বেগম (৩০) গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জসিমের স্ত্রী হেনা আক্তারের দাবি, কিছুদিন আগে ছিনতাইকারী ধরিয়ে দেওয়ার খেসারত দিয়েছে জসিম। বাড়ি ফেরার সময় একই এলাকার শরিফ, তুহিন, শহিদুল, সুজন, রিয়াজ, ব্লেড রনির সঙ্গে তার (জসিম উদ্দিনের) কথা কাটাকাটি হয়। তখন শহিদুল জসিমকে গুলি করে। এর মাত্র কয়েক দিন আগে তিন দিনের ব্যবধানে দুটি গুলির ঘটনা ঘটে একই এলাকায়।
১ ফেব্রুয়ারি রাতে হাতিরঝিলের উলনে দুই কিশোর গ্রুপের গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জিলানী নামের এক কলা ব্যবসায়ী ও শুভ নামের এক পথচারী। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রামপুরা ওয়াপদা সড়কে একদল মুখোশধারীর ছোড়া গুলিতে আহত হন ইন্টারনেট কর্মচারী মো. সুমন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, একটি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন সুমন। হঠাৎ ১২ থেকে ১৫ জন মোটরসাইকেলে এসে এলোপাতাড়ি গুলি করে চলে যায়। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন্স) এস এন মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা তো কাজ করছি। তথ্য পেলেই অভিযান চালাচ্ছি। ইনফরমেশন থাকলে দিন। বিশেষ অভিযান চলছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীর চরে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের গুলিতে রাজু হোসেন (১৮) নামের এক যুবকের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। নিহত রাজু ওই ইউনিয়নের ফারাকপুর ভাঙ্গাপাড়া এলাকার ইব্রাহিম প্রামাণিকের ছেলে। তিনি বালুরঘাটে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তবে কী কারণে কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে, এখনো তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কতজন অপরাধী গ্রেপ্তার হলো এটা দেখতে চায় না সাধারণ মানুষ। তারা দেখতে যায় কারা গ্রেপ্তার হয়েছে। শুধু চুনোপুঁটি নয়, অপরাধের নেপথ্য কুশীলবদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবেই রাষ্ট্র-সমাজে শান্তি ফিরবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্রমাগত সমালোচনা করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে অনেক সময় লাগবে। তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে? আবার কোনো বাহিনী বিলুপ্তির আগে ভেবে দেখতে হবে আমরা কি আসলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়া চলতে পারব? এজন্য উচিত হবে বাহিনীগুলোর দুর্বল পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে তাদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আরও জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা।
জানা গেছে, অবৈধ এবং বাহিনীগুলোর লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে মন্থরতার সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। তুচ্ছ ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে বিরোধে। মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে একে অন্যের দিকে গুলি ছুড়ছে। গত আট দিন ধরে সারা দেশে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হলেও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কারণ ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনা থেকে ১১ ধরনের ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছে। এখনো উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া ১ হাজার ৩৯২টি অস্ত্র, যার মধ্যে পিস্তল রয়েছে ৬৮৩টি। পুলিশের বাইরে অন্যান্য বাহিনীরও অস্ত্র লুট হয়েছে। যেগুলোর হিসাব প্রকাশ্যে আসেনি। এখনো বেহাত অবস্থায় আছে পুলিশের ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১ রাউন্ড গোলাবারুদ। গত ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সদ্য জেল ফেরত এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম করে ধানমন্ডি ৭-এ মোটরসাইকেলে করে আসা অস্ত্রধারীরা একটি নির্মাণাধীন ভবনের সামনে ১০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। একটি ভবনের ফটকে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ভেঙে ফেলে সিসি ক্যামেরা।
লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকাকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গুলি করে হত্যা করেছে শেখ তন্ময় নামে এক যুবক। গত ৩০ ডিসেম্বর সকালে শাহিদা ইসলাম রাফার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২ ডিসেম্বর ভোলা থেকে গ্রেপ্তার হন তন্ময়। পরে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বটতলী বেইলি ব্রিজের নিচের ডোবা থেকে হত্যকান্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। এ সময় রাস্তার পাশে শাহিদার রক্তমাখা ভ্যানিটি ব্যাগটিও পাওয়া যায়।
র্যাব সদর দপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে র্যাবের প্রতিটি সদস্য তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার এবং অপরাধী গ্রেপ্তারে প্রতিটি ব্যাটালিয়ন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করেই কাজ করছে।