বুধবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৩ ১৪৩২   ১৭ শাওয়াল ১৪৪৬

তুলসি ঝড়ে ঢাকা-দিল্লী

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:০৩ এএম, ২২ মার্চ ২০২৫ শনিবার


#    বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রিত হচ্ছেন তুলসী গ্যাবার্ড
 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ ঝড় তোলেন তুলসি গ্যাবার্ড। ট্রাম্প প্রশাসনের গোয়েন্দা প্রধান। ভারত সফরে এসে তার কিছু মন্তব্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তার ওই সকল মন্তব্যে একটা দমকা হাওয়া বাংলাদেশের আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে। শুধু রাজনৈতিক অঙ্গন নয়; সাধারন মানুষের মধ্যেও শোরগোল পড়ে যায় তুলসির মন্তব্যে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন। তার ওপর বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খীস্টান, ক্যাথলিক সবার ওপর নির্যাতনে ট্রাম্প প্রশাসন চিন্তিত। বাংলাদেশে ইসলামী উগ্রপন্থীদের উত্থান যা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেটাও চিন্তার বিষয়। এসব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন ক্যাবিনেট বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এমন মন্তব্য যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর’ অভিযোগ; সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেনও সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের নীলাকাশে এটা হঠাৎ একটা কালোমেঘের ধাক্কা বলে মনে হয়েছে। সবাই বলাবলি করছে, তুলসি গ্যাবার্ড ভারতের চোখ দিয়েই বাংলাদেশকে দেখলেন।
তুলসি গ্যাবার্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তার মা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং সন্তানদেরও হিন্দু হিসাবে বড় করেছেন। তুলসি ইসকনের একজন ভক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘূদের ওপর নির্যাতনের যে অভিযোগ করেছিলেন; ওই বিবৃতি দিতে তুলসি গ্যাবার্ডের প্রভাব ছিলো বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স পরিচালক তুলসি ডিএনআই (ডাইরেক্টর, ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স) হিসাবে অধিক পরিচিত। বিশে^র বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা প্রধানদের সম্মেলন রাইসিনা ডায়লগে যোগ দিতে তিনি ভারত সফরে যান। দিল্লিতে তিনি দুইটি মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দেন। একটি হলো, এনডিটিভি; অপরটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মাল্টিমিডিয়া বার্তা সংস্থা এএনআই। উভয় মিডিয়ার উপস্থাপকই বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলেন। জবাবে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা জানান তুলসি গ্যাবার্ড। সাক্ষাৎকার প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় উঠে। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশে প্রচন্ডভাবে প্রভাব পড়ে। সেটার প্রমাণ মিলল, সেদিন মধ্যরাতে বিবৃতি দিয়ে তুলসি গ্যাবার্ডের মন্তব্যকে নাকচ করে বিবৃতি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে তুলসি গ্যাবার্ডের মন্তব্যকে বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার এক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এদেশের সাধারন মানুষ ধর্মীয় ব্যাপারে উদার। কেউ উগ্রবাধকে সমর্থন করে না। এটাই বাস্তবতা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, কোনও প্রকার প্রমাণ ছাড়াই বাংলাদেশের ওপর ব্রাশ দিয়ে কালিমা লেপন করে দেওয়া হয়েছে। গোটা বিশে^ই সন্ত্রাস একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটা মোকাবেলা করা কঠিন। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এবং এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করছে।
ভারতের সঙ্গে বর্তমান অর্ন্তবর্তি সরকারের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেবার পর থেকে দুই প্রতিবেশির সম্পর্ক অনেকটা টালমাটাল হয়ে পড়ে। তার প্রভাব নানা দিকে পড়ছে। এটা অর্ন্তবর্তি সরকার অস্বীকার করে না যে, গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হওয়ার পর পরই হিন্দুদের ওপর আক্রমন হয়েছে। আর তখনই ভারতের তরফে উদ্বেগ জানানো শুরু হয়। ওভাল অফিসে গ্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকেও মোদি বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
বাংলাদেশে পাঁচ আগস্টের পর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বেশ চাঙ্গা। জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীর এমন কি নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরিরও ঢাকায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে মিছিল বের করেছে। যদিও পুলিশ তাদের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। মিছিলে হিজবুত -তাহরিরের মিছিল থেকে ‘খেলাফত, খেলাফত’ বলে শ্লোগান শোনা গেছে। এসব বিষয়গুলো থেকে তুলসি গ্যাবার্ড ধারণা করে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশে ইসলামি উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। তাছাড়া, কতিপয় উগ্রপন্থী লোক বিভিন্ন সুফি মাজারে হামলা চালিয়েছে। তবে এসব ঘটনা শক্ত হাতে দমন করার বিষয়ে অর্ন্তবর্তি সরকারের তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে এটা ঠিক যে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলো বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় নয়। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। বাংলাদেশের মানুষ যে কোনও ধর্ম বর্ণের সঙ্গে পারস্পরিক সহাবস্থান করে। এই বিষয়গুলো মার্কিন প্রশাসনের সামনে তুলে ধরতে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তি সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী ড, মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার এখন তুলসি গ্যাবার্ডকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ভাবছে। এছাড়াও, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার লক্ষে ইলন মাস্কের স্টার লিংককে বাংলাদেশে আনতে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে যে কোনও অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে যাচ্ছে তাতে করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অতীতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টস শিল্প এবং অন্যান্য বিষয়ে বারবার সতর্কবার্তা ঘোষণার পরও শেখ হাসিনার সরকার মার্কিন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গার্মেন্টস শিল্পকে তাই জিএসপি সুবিধা হারাতে হয়েছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চালু হয়েছে। এখন শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উঠছে না। তাই আশা করি, বর্তমান অর্ন্তবর্তি সরকারও অভিযোগ অস্বীকার করেই দায় এড়ানোর চেষ্টা করবে না। বরং ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তার উদ্বেগ দূর করার আন্তরিক চেষ্টা চালাবে।