ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের সামনে কঠিন সময়
মাসুদ করিম; ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৯:২৪ পিএম, ৫ এপ্রিল ২০২৫ শনিবার
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘গ্রেট ডিজরাপটার’ হিসাবে সবাই মানে। ভোটে তিনি জয়ী হবার পর থেকেই সবাই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিছু ওলট-পালট হবে। সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। নতুন পরিস্থিতি যে বাণিজ্য নিয়ে হবে সেটাও সবাই অনুমান করেছিলেন। কারণ ট্রাম্পের মতো একজন বড় ব্যবসায়ী বাণিজ্যিক হিসাবকে তার প্রথম মেয়াদে রাজনীতির চেয়ে উপরে রেখেছিলেন। তখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে মেতেছিলেন। এবারের পরিস্থিতি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির অধিকাংশ আমদাণি পণ্যের ওপর ১০ থেকে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন। গত এক শতাব্দির মধ্যে এত উচ্চ শুল্ক আরোপ করেনি ওয়াশিংটন। বুধবার গৃহীত এই সিদ্ধান্তে চীনের ওপর নূতনভাবে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। কিছুদিন আগে ট্রাম্পের আরোপিত ২০ শতাংশ শুল্কসহ বেইজিংয়ের ওপর মোট ৫৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ওপরও কম শুল্ক আরোপ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজরেও ১০ ডলার মূল্যের একটি টি শার্টের রফতানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের শুল্ক ১৫ শতাংশ হারে গুনতে হতো দেড় ডলার। এখন ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলেএকই টিশার্টে ৩ দশমিক ৭ ডলার শুল্ক গুনতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্টের বাজারে সেই টি-শার্টের দাম পড়বে ১৩ দশমিক ৭ ডলার। মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রেতার চাহিদা কমে বাজার সংকোচিত হতে পারে। যার প্রভাবে দেশের রফতানি খাতে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ইস্যুর ইতিবাচক সমাধান হবে। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। যেহেতু এটি আলোচনারযোগ্য, তাই আমরা আালোচনা করবো। আমি নিশ্চিত যে, আমরা সর্বোত্তম সমাধানে পৌঁছাতে পারবো। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। তবে এটাও ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তা পরিবর্তন খুব হতে দেখা যায় না। বাংলাদেশের ওপর জিএসপি সুবিধা বাতিল করার পর বহুবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই বিষয়ে জিএসপি সুবিধার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কোনও ফল আসেনি। নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জটিল ব্যবস্থায় কোনও সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তা পরিবর্তন করাটা কঠিন কাজ। তাই বিশে^র বিভিন্ন দেশ নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি জোর দিয়েছেন। ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলন ঘিরে এই সব আলোচনা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরী পদক্ষেপ হিসাবে নিকটতম প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করার বিষয় চিন্তা করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হলো, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে এখন অবিশ^াসের কালোমেঘ জমে আছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের মাধ্যমে সেই মেঘ আরও ঘন কালো হয়েছে। ফলে প্রধান উপদেষ্টার একটি বক্তব্য নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। চীনে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
ভারত সর্বদা চিকেন নেক খ্যাত শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে চিন্তিত থাকে। ভৌগোলিক অবস্থার কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই শিলিগুড়ি করিডোর। তার বাইরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের দুই অংশে যোগাযোগ সম্ভব। শিলিগুড়ি করিডোর বন্ধে চীনের আগ্রহ থাকতে পারে। সেই চীনেই ভারতের উত্তর-পূর্বাচলের বিষয়ে ইউনূসের মন্তব্য ভারতের নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়টি। মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া লক হলে ভারতের নর্থ ইষ্ট বাংলাদেশ লকড। বাংলাদেশ হলো বঙ্গপোসাগরের গার্ডিয়ান। ভারত বিষয়টাকে তাদের নিরাপত্তাজনিত হুমকি বলে বিবেচনা করছে। তাই ভারতীয়রা বাংলাদেশকে পাল্টা নিরাপত্তা হুমকির দিক নিয়ে আলোকপাত করছে। ফেনীর দিকে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে বলে ভারতীয়রা আঙ্গুল তুলছে। ফলে ঝুঁকি উভয় দিকেই আছে। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যে, বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে একটি ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে যে, ড. ইউনূসের বক্তব্য নতুন কিছু নয়। প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেসেনটেটিভ খলিলুর রহমান ব্যাখ্যা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা মূলত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বলছেন।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ সহযোগিতা করতে পারে। এতে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল কানেকটিভিটি বাড়াতে পারে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা ভারত সফরকালে একই ধরনের সহযোগিতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এটা একেবারেই নতুন কিছু নয়। ড. ইউনূসও সেই কথাই বলেছেন। ফলে ইউনূসের বক্তব্য নিয়ে ভারতে যে হৈহৈরৈরৈ যেটা চলছে সেটা একটি কোলাহল ছাড়া কিছুই নয়। এটার মধ্যে সারবত্তা নেই। তবুও সম্পর্ক খারাপের নমুনা এই একটি ঘটনা।
ট্রাম্পের আমলে শত্রুমিত্র একাকার হয়ে গেছে। শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বাণিজ্য যুদ্ধ করে বাংলাদেশ তসনস। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প ছিলো প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সুরক্ষা করে চলে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের বিকল্প ব্যবস্থাও বাংলাদেশের হাতে নেই। ফলে বাংলাদেশের সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএআইডি’র সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেবার পর বাংলাদেশের এনজিও খাত সর্বগ্রাসী সংকটে পড়েছে। অনেক মানুষ চাকুরি হারাচ্ছেন। এখন শুল্ক আরোপ করে নতুন সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। এই ক্ষেত্রে সকল প্রতিবেশির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা অন্যতম প্রধান কাজ।