মঙ্গলবার   ০৮ এপ্রিল ২০২৫   চৈত্র ২৪ ১৪৩১   ০৯ শাওয়াল ১৪৪৬

দু-এক দিনের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠি দেবে সরকার

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৩৮ এএম, ৭ এপ্রিল ২০২৫ সোমবার

  • শুল্ক আরোপের বিষয়টি তিন মাস পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হবে
  • যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হবে
  • শুল্ক ও অশুল্ক বাধা নিরসনে গুরুত্বারোপ

 

বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্দেশ্যে গত বুধবার বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ৯ এপ্রিল থেকে তার রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে। এটি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বেশ সমস্যায় পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ সরকার। আগে কোন প্রস্তুতি না থাকায় হঠাৎ ট্রাম্পের ঘোষণায় একপ্রকার দিশেহারা বাংলাদেশ।

এমন পরিস্থিতিতে শুল্ক আরোপের বিষয়টি পিছিয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়ে সরকারের নানা ধরনের উদ্যোগের কথা জানিয়ে মার্কিন প্রশাসনকে চিঠি দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এ বিষয়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো দফায় দফায় সভা করে মার্কিন পাল্টা শুল্কের ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হবে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

গতকাল বিকালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠক করেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। সেখানেও প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে পাল্টা শুল্ক তিনমাসের জন্য স্থগিত করা এবং বাংলাদেশ আরও কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেসব বিষয় জানিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে একমত হন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুটি চিঠি প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে পাঠানো হবে।

বৈঠক সম্পর্কে প্রেস সচিব বলেন, প্রতিনিয়ত তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি) সঙ্গে আমরা কথা বলছি। তাদের মধ্যে ঢাকায় তাদের দূতাবাসের কর্মকর্তা ছাড়াও ইউএসটিআরের কর্মকর্তারা রয়েছেন। আমাদের যেটা ডিসিশন, আমরা দুটি চিঠি দেব। দুটিই আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যাবে। একটা চিঠি যাবে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। আরেকটা চিঠি যাবে আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টার তরফ থেকে ইউএসটিআরের কাছে।

চিঠির বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিঠিতে কী কী থাকবে, কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হবে সেটা নিয়েই আজকে আলোচনা হয়েছে। আজকে চারজন উপদেষ্টা ছিলেন, একজন হাইলি রিপ্রেজেন্টার ছিলেন, একজন স্পেশাল অ্যাম্বাসেডর, আমাদের প্রায় দশজনের মতো সেক্রেটারি ছিলেন, যারা বড় ব্যবসায়ী তাদের মধ্য থেকে চারজন প্রতিনিধি ছিলেন। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। আলোচনার পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুটি চিঠি যাবে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গতকাল সকালে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ট্রাম্প প্রশাসনকে অনুরোধ জানানোর সুপারিশ করেছেন ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা। তারা বলেছেন, ৯ এপ্রিলের আগে এ বিষয়ে ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। কারণ, ৯ এপ্রিল থেকে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে। বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছাড়া ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অংশ নেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান, গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক, পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ প্রমুখ।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায়ী, গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের বিষয়টিকে শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে হবে না। এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত। তাই এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশটির বাণিজ্য সংস্থা, পণ্য আমদানিকারক সবার সঙ্গেই পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

পাল্টা শুল্ক কমানোর প্রক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক–করভার তড়িঘড়ি করে কমিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত না নেওয়ারও সুপারিশ করেছেন একজন গবেষক। তিনি মত দেন, এ বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা বা তারা কী চায়, সেটি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। সেটি না করে হুট করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হলে তাতে লাভের লাভ কিছু হবে না।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন— ৯ এপ্রিলের আগে ক্রয়াদেশ দেওয়া পণ্যের মধ্যে যেগুলো এখন বাংলাদেশে উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে রপ্তানিকারকদের মধ্যে। তাই এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে থাকা পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয় এবং তাতে ক্রেতারা পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।

বৈঠকে একাধিক গবেষক মত দেন, বিশ্বের অনেক দেশের ওপর এই পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বলে তাদের যা হবে বাংলাদেশেরও একই পরিণতি হবে বলে মনে করলে ভুল হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগী দেশ চীন ও ভিয়েতনামের আর্থিক ধাক্কা সামাল দেওয়ার যে সক্ষমতা রয়েছে, আমাদের সেটি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা যদি পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়, সেটি পুষিয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতা চীন ও ভিয়েতনামের রয়েছে। তাদের তুলনায় বাংলাদেশের সক্ষমতা খুবই কম।

বৈঠকে একাধিক ব্যবসায়ী সুপারিশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি সহজ করতে বাংলাদেশে দেশটির রপ্তানিকারকদের জন্য সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। সেটি না হলে ব্যবসায়ী পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়বে না। বর্তমানে শূন্য শুল্কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করা যায়। তা সত্ত্বেও দেশের তুলা আমদানির বড় অংশই আসে চীন ও ভারতে থেকে। কারণ, এই দুটি দেশ থেকে ব্যবসায়ীদের তুলা আমদানি সহজ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানি বাড়াতে হলে দেশটিকে সরবরাহ সুবিধা দিতে হবে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া এক গবেষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, পাল্টা শুল্কের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম এ বিষয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ফলে তারা ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যা কিছু করার দু-এক দিনের মধ্যেই করতে হবে বলে জানান তিনি।