রোববার   ১৩ এপ্রিল ২০২৫   চৈত্র ২৯ ১৪৩১   ১৪ শাওয়াল ১৪৪৬

ইউনূসের নিশানা ট্রাম্পেই টার্গেট ট্রাম্পের আস্থা অর্জন

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৪৭ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২৫ শনিবার


 

নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূস অর্ন্তবর্তি সরকারের প্রধান হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কেননা হিলারি ক্লিনটনসহ যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা ইউনূসের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু বাস্তবে মার্কিন ভোটে ডেমোক্রেটিক পার্টি পাস করতে পারেনি। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে পড়ে। বিশে^র অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের ট্রাম্প স্বভাবসুলভ ব্যবসায়িক হিসাব নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষ। তাই ক্ষমতায় গিয়েই ‘আমেরিকা ফাস্ট’ নীতির প্রয়োগ ঘটালেন। বিশ^জুড়ে মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি’র সহায়তা বন্ধ করে দিলেন। ট্রাম্পের যুক্তি অকাট্য, এই সহায়তা দিয়ে আমেরিকার কোনও লাভ হয় কিনা ! যদি না হয় তবে সেগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। যেমন কথা তেমনি কাজ, সারা দুনিয়ায় ইউএসএঅঅইডি’র সহায়তা বন্ধ ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এতে করে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক বিরুপ প্রভাব পড়ে।
ইউএসএআইডি বন্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে বাংলাদেশের এনজিও খাত। এনজিও খাতে কোনও ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ নেই। তাই কর্মিরা ছাটাইয়ের মুখে পড়েন। প্রথম রাতেই আইসিডিডিআরবি আর্থিক সংকটের কথা বলে এক হাজার কর্মী ছাটাই করে। এনজিও খাত তিন ভাবে ক্ষতির শিকার হয়। প্রথমত অনেক এনজিও সরাসরি ইউএসএআইডি থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে প্রকল্প পরিচালনা করে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু এনজিও আছে সরাসরি ইউএসএআইডি থেকে সহায়তা নেয় না। তারা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওই সকল সংস্থার অর্থ আসে ইউএসএআইডি থেকে। তৃতীয়ত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউএনডিপি, ডব্লিউএইচও প্রভৃতি থেকে অর্থ নিয়ে এনজিও পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো অর্থ পায় ইউএসএআইডি থেকে।
ইউএসএআইডি’র তহবিল স্থগিতের প্রভাব সর্বগ্রাসী হলেও কেউ তা প্রকাশ করতে আগ্রহী হয় না। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আইসিডিডিআরবি’র এক হাজারের বেশি কর্মি ছাটাইয়ের বাইরে কেয়ার বাংলাদেশ তাদের তিনটি প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। এর ফলে প্রায় আড়াইশ’ লোক ছাটাইয়ের শিকার হন। জেএসআই, আরটিআই, মট-ম্যকডোনাল্ড, আইআরসিসহ স্থানীয় ১৫-২০টি এনজিও মিলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রকল্প পরিচালনা করছিলো। ইউএসএআইডি’র তহবিল বন্ধ হওয়ায় তারাও প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে কর্মরত প্রায় সকল এনজিও পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এনজিও বিষয়ংক ব্যুরোর হিসাবে বাংলাদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলে ২৪৪ এনজিও ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে ৪৫০টি প্রকল্প পরিচালনা করে। এ সকল প্রকল্পে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ কর্মরত। তারা সবাই এখন চাকুরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে আছেন। তিন মাস পর পুরো চিত্র স্পষ্ট হবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তিন মাস পর তাদের সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তন করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
ট্রাম্প অবশ্য এই বিষয়টা গোটা বিশে^র জন্য করেছেন। যদিও বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে বাংলাদেশের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন মূলত দুর্নীতির অভিযোগ এনে। তিনি বলেছেন, মাত্র দুইজন মিলে একটি এনজিও পরিচালনা করে ইউএসএআইডি থেকে নিয়েছেন ২৯ মিলিয়ন ডলার। এ এক মহাকেলেঙ্কারি !
বাংলাদেশকে টার্গেট করে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন তুলসি গ্যাবার্ড। তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের গোয়েন্দা প্রধান। তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘূ নির্যাতনের অভিযোগ আনেন। তিনি এও অভিযোগ করেন যে, বাংলাদেশে উগ্রগোষ্ঠী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দিল্লিতে বসে তুলসির এসব মন্তব্যে ইউনূসের সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
ট্রাম্প গোটা বিশে^ বাণিজ্য ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। বাংলাদেশী পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় হয়। অথচ ভারতের ওপর শুল্কের পরিমাণ ২৬ শতাংশ। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবর একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার আবেদন করেন। ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য ১০ শতাংশ বর্ধিত শুল্ক রেখে চীন বাদে গোটা বিশে^র জন্য বাড়তি শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রফতানি করেন। তার ওপর আরও ১০ শতাংশ বর্ধিত শুল্ক আরোপ থাকায় ২৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রফতানি করতে হবে। মুহাম্মদ ইউনূস চিঠিতে অঙ্গীকার করেন যে, ট্রাম্পের বাণিজ্য এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কাজ করবে।
এরিমধ্যে ভারত ঘোষণা করেছে যে, ভারতের কোনও বিমান বন্দর দিয়ে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির অনুমতি বাতিল করেছে দিল্লি। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় বাংলাদেশকে দ্বিগুন ব্যয়ে পোশাক রফতানি করতে হবে। ভারত বলছে, তাদের বিমান বন্দরে জট লেগে গেছে। ফলে নিজ দেশের পণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভারত এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানান। এসব কারণে বাংলাদেশের রফতানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।   
ট্রাম্প প্রশাসনের দুইজন জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা চলতি মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সফর করবেন। তার মধ্যে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রুটিন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে আসছেন। এই আলোচনায় শুল্ক, বাংলাদেশের সংস্কার, নির্বাচন প্রভৃতি বিষয় জানতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি সম্ভবত মিয়ানমারের পরিস্থিতি আলোচনা করবেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের আস্থা অর্জনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ককে বাংলাদেশে এনেছেন। এছাড়াও, নাসার সঙ্গে চুক্তি করেছে অর্ন্তবর্তি সরকার।