রোববার   ১৩ এপ্রিল ২০২৫   চৈত্র ২৯ ১৪৩১   ১৪ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলা নববর্ষই সর্বজনীন

মনিজা রহমান

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫৭ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২৫ শনিবার


 

যা কিছু  সর্বজনীন, তাই গ্রহণযোগ্য। সর্বজনীনতার ধারণা হৃদয়ে প্রোথিত করতে প্রয়োজন হয় বহু যুগ। মানবসমাজে সর্বজনীনতার ওপরে কিছু নেই। ধর্ম বর্ণ বা অন্য কোনো পরিচয় নির্বিশেষে একটি দিন, একটি উৎসব যখন বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক দ্যোতনা নিয়ে আসে তখন তার পরিসর বিশাল হয়ে ওঠে। সে কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষকে তার সাথে সম্পৃক্ত করে নিতে পারে। আমাদের পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ তেমন একটা দিন।
বাংলা নববর্ষ অনেক বেশি মানুষের মনে ঠাই করে নিতে পেরেছে মূলত দুটি কারণে , এক, অর্থনীতি আর দুই, সংস্কৃতি। দুটিই মানবজীবনের অনিবার‌্য অনুষঙ্গ। একদা ১৫৮৪ খ্রিস্ট অব্দে কৃষিকাজে কৃষকদের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর বাংলা নতুন বছর গণনার সূত্রপাত করেন। তবে তা ছিলনা তাঁর স্বকপোল কল্পিত। তিনি প্রচলিত পঞ্জিকা এবং হিজরি পঞ্জিকা সামনে রেখে আধুনিকায়ন করেন। চান্দ্রমাস পরিহার করে সৌর পঞ্জিকায় রুপান্তর করেন। এই পঞ্জিকার কারণে কৃষক সমাজের সামনে থেকে ছায়াচ্ছন্নতা দূর হয়। ফসল বোনা এবং কাটা সহজতর হয়। ফলে বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর দিন।
সংস্কৃতির সাথে অর্থনীতির সংশ্লিষ্টতা অপরিহার‌্য। অর্থনীতির ছাত্রি হিসাবে আমি তা অনুধাবন করতে পারি। সেকালের সংস্কৃতিও ছিল আর্থিক কর্মকা-ের সাথে সংশ্লিষ্ট। বৈশাখী মেলা নামে তখন যা হতো তা ছিল প্রধানত বাজার সংস্কৃতি। ফসল ছাড়াও হাতে তৈরি কারুশিল্পের বেচা-কেনার সাংবাৎসরিক হাট ছিল বৈশাখী মেলা। এই মেলাকে সকলের কাছে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করার জন্য সেখানে আয়োজিত হতো বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী আউল-বাউল-ফকিরের গান। সে কারণে বাংলা নববর্ষ কেবল দিন পঞ্জিকার একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালির হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতি উদযাপনেরও একটি দিন। যেহেতু এর সাথে সাংস্কৃতিক ব্যাঞ্জনা জড়িত, তাই এর গায়ে ধর্ম বর্ণ বা অন্য কোনো কূপম-ূকের কালিমা লেপন  সম্ভব হয়নি।
এই নববর্ষকে কোণঠাসা করার নানা অপচেষ্টা হয়েছে কালে কালে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু সংস্কৃতি হচ্ছে ঝর্ণা ধারার মত, তাকে রোধ করা সম্ভব নয়। গ্রাম-বাংলার এই একান্ত নিজস্ব বৈশাখী মেলা বা নববর্ষ উদযাপন, নতুন যুগের গোরাপত্তনের সাথে সাথে ঠাই করে নিয়েছে নগরবাসির উদযাপনেও। তবে তা তার অকৃত্রিম গ্রামীণ রূপে বা অবয়বে নয়, বরং নতুন ও আধুনিক মাত্রায়, নতুন অনুসঙ্গে, নতুন চেতনায় প্লাবিত হয়ে-যাতে নাগরিক মানুষ এর মধ্যেই খুঁজে পায় তাদের অতীত ঐতিহ্য। সমকালীন আনন্দের সাথে লোকায়ত অনুভব মিশিয়ে উপভোগ্য করে তোলে। অতীত ঐতিহ্য এবং সমকালীনতার মিথস্ক্রিয়ায় এর সর্বজনীনতা প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। এইখানেই বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে বড় শ্লাঘা। আধুনিক বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে শুরু করে) পহেলা বৈশাখকে সবচেয়ে তাৎপর‌্যময় করেছে ছায়ানট। নতুন বছরের শুরুর দিন খুব ভোরে রমনার বট্মূলে তারা যে আয়োজন করে তাকে বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে পরিশীলিত প্রকাশ বলা যেতে পারে। পরবর্তী পর‌্যায়ে সংযোজিত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা।
জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপি মানবসভ্যতার বিকাশে যেসব প্রতœতত্ত্ব ও উল্লেখযোগ্য অনুসঙ্গ রয়েছে তা শনাক্ত ও চিহ্নিত করে। তাদের নজরও এড়ায়নি বাঙালি সংস্কৃতির এই অকৃত্রিম ভালোবাসা ও চেতনায় জড়ানো বর্ণিল দিনটির প্রতি। পহেলা বৈশাখ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা  এখন সেই ঐতিহ্যের অংশ।
যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা সূর্যের আলোর মত। তাকে আটকে রাখা যায়না। বিপুলসংখ্যক বাঙালি দেশান্তরি। তারা যেখানে যায় সেখানে সাথে নিয়ে যায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে । কারণ বাঙালিরা আত্মমর‌্যাদাবোধ সম্পন্ন। তারা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে চায়না। বাঙালিদের আত্মপরিচয়ের অন্যতম সোপান তাদের সংস্কৃতি । আর বাঙালি সংস্কৃতির অনাবিল প্রকাশ বাংলা নববর্ষ উদযাপনে। নিউ ইয়র্কের বাঙালিরাও তাদের সংস্কৃতিকে এই মহানগরিতে তুলে এনেছে সযতেœ।একদা যা ছিল খুব ছোট পরিসরে, ক্রমান্বয়ে তার ব্যাপ্তির বলয় বিস্তৃত হচ্ছে। শুধু পোশাক নয়, এই উদযাপনে আবশ্যিক হিসাবে থাকে শখের পান্তা । তার সাথে নানাপদের ভর্তা এবং ইলিশ ভাজা। নিউইয়র্কের রাস্তায়ও এইদিন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে বিভিন্ন সংগঠন।
আমাদের হৃদয়ের ভেতরে ঠাই নেয়া পহেলা বৈশাখ এখন জায়গা করে নিয়েছে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটে। এবছর প্রথম একটি রেজোল্যুশনের মধ্য দিয়ে সিনেট এই দিনটি উদযাপন করবে। ৭ এপ্রিল আলবেনির ক্যাপিটল বিল্ডিঙের সিনেট চেম্বারে পালিত হবে বাংলা নববর্ষ । এটা বাঙালিমাত্রই আনন্দের আর গৌরবের খবর। বহুবছর আগে বঙ্গদেশের কোনো শীর্ণ কায়া নদীর পাড়ে বট গাছের ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে বসা বৈশাখী মেলা ঢাকার রমনা বা বাংলা একাডেমির বটতলার নাগরিক আয়োজনের রেশ ধরে এখন বহুভাষী মানুষের শহর নিউইয়র্ক সিটি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে স্টেটের ক্যাপিটলে।
প্রাণখুলে অভিনন্দন জানাই এর উদ্যোক্তাদের। এই অর্জন বাঙালিদের এবং বাঙালি সংস্কৃতির ।