সোমবার   ২৮ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ১৪ ১৪৩২   ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬

ব্যাংক খাত ছিল পতিত সরকারের রাজনীতির হাতিয়ার

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:১৩ এএম, ২৭ এপ্রিল ২০২৫ রোববার

  • ব্যক্তি গোষ্ঠী স্বার্থে আইন সংশোধনে সুশাসন দুর্বল
  •     নতুন সংজ্ঞায় বাড়বে খেলাপি ঋণ

 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশের ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে বিগত সরকার তার রাজনৈতিক বলয়কে তোষণ করেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে করপোরেট সুশাসন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। ২০১৭ সালে একটি একক শিল্প গ্রুপের হাতে সাতটি বেসরকারি ব্যাংক তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া একের পর এক ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে।

এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে লম্বা সময় ধরে কাঠামোগত দুর্বলতা ও অদক্ষতা বিরাজ করছে। এর পাশাপাশি করপোরেট সুশাসনের অভাব ও নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমের দুর্বলতাসহ রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। আর এসবের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে নির্দেশিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

সংজ্ঞাগত দুর্বলতার সুযোগে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এক বাংকের পরিচালকের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সখ্য গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংক পরিচালকরা পরস্পরের ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে। এভাবে ৮টি ব্যাংকের পরিচালকরা পরস্পরের মধ্যে তিন দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের সমান ঋণ তুলে নিয়েছেন। টাকার অংকে যার পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এভাবে পারিবারিক যোগসাজশে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণের নামে ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহক সৃষ্টিতেও অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছে।

২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকে পারিবারিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে। ২০২৩ সালে আইন সংশোধন করে একজন উদ্যোক্তা পরিচালকের একনাগাড়ে ১২ বছর পরিচালনা পর্ষদে থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয় ব্যাংকে। এর পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সংখ্যা এই সংশোধনের মাধ্যমে সীমিত করা হয়। ফলে করপোরেট সুশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।

এসব কারণে ব্যাংক খাতে সম্পদের মান খারাপ হয়, মূলধনের ঘাটতি দেখা দেয় এবং তারল্য পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর যখন এ খাতে সংস্কার উদ্যোগ শুরু হয়, তখন ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। এর ফলে ব্যাংকের সার্বিক ব্যবসা ও ঋণ বিতরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যাংক খাতে গড় খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের ওপরে পৌঁছে যায়। এ মানের খেলাপি ঋণ থাকলে যেকোনো দেশের ব্যাংক খাতে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

বিশ্বের যেসব দেশে এর আগে ব্যাংক খাতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, সেখানে মোটামুটি খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ শতাংশের কাছাকাছি। খেলাপি ঋণের ৪৬ শতাংশই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৯টি ব্যাংকে। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নতুন যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে তা চলতি এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এটি কার্যকর হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। এই উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাকগুলোকে বিপুল অর্থ সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর নতুন বিনিয়োগের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

ব্যাংক খাতের এসব সম্যস্যা সমাধানে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো- ব্যাংক খাতের নীতিকাঠামো উন্নত করতে অগ্রাধিকার প্রদান; আমানত সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করা; প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতি; রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পুনর্গঠন; খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি; সমন্বিত দেউলিয়া আইন প্রণয়ন; ব্যাংকিং আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা; জরুরি প্রয়োজনে তারল্য সহায়তা প্রদানের জন্য একটি নীতি কাঠামো তৈরি; ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে আন্তর্জাতিক উত্তমচর্চাগুলোর অনুশীলন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে কি উদ্যোগ নেওয়া উচিত এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে কাজ করা দরকার তা হচ্ছে আইনি কাঠামো ঠিক করা। এরই মধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ হয়তো জারি হবে। এর বাইরে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন পরিচালনগত সুশাসন ঠিক করার জন্য অনেকগুলো ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিছু ব্যাংকের ঋণ বিতরণ এবং লভ্যাংশ বিতরণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক আমানতের সুরক্ষার জন্য যে সুপারিশ করেছে, সেটি বাস্তবায়নে আমানত বীমা ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এসব উদ্যোগ কতটা টেকসই হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এসব উদ্যোগ কতটা টেকসই হবে সেটা পরবর্তীতে যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আইন-কানুনে কোথাও রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়ার বিধান নেই। অতীতে যা ঘটেছে তা হচ্ছে নিয়ম লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এসব হস্তক্ষেপ বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে।