শ্রমঘন শিল্প খাত বিকাশের সুযোগ দিতে হবে
নিউজ ডেক্স
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৫:২৯ এএম, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার
বাংলাদেশের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি অন্যতম। বিশেষ করে মানসম্মত ও শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনাও জরুরি। শ্রমঘন শিল্প খাতকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এ পরামর্শ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এমপ্লয়মেন্ট সেক্টরের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলামের।
এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার কমই বলতে হবে। তবে অনেক মানুষ এমন কাজ করছেন, যা থেকে পর্যাপ্ত আয় হচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষই নিম্ন আয়ের কাজে নিয়োজিত। অনেকে বাধ্য হয়ে স্ব-কর্মসংস্থানে যুক্ত। এ অবস্থা থেকে বের হতে রফতানিমুখী শ্রমঘন শিল্পের বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ইলেকট্রনিক্স, পাদুকা এবং আসবাবের মতো খাতগুলোতে যাতে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেন, তার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য এখনই প্রয়োজনীয় নীতিমালা করা উচিত। কারণ এরই মধ্যে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে।
রিজওয়ানুল বলেন, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ছিল তিন দশমিক ৩২ শতাংশ; যা ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এক দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছে। এটি উদ্বেগের। আরও উদ্বেগের বিষয়, শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত শিল্প খাতে কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধি ছিল ছয় দশমিক তিন শতাংশ। যা ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে হয়েছে চার দশমিক দুই শতাংশ। অন্যদিকে তরুণদের বেকারত্বের হার আট শতাংশের বেশি। আবার দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে এমন শিল্প খাতেও দীর্ঘদিন ধরে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। যেমন তৈরি পোশাক খাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও ছোট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই শ্রমঘন শিল্প ও সেবা খাতের সম্প্রসারণ না হলে সরকারের নিজের ও বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলো অর্জনের চ্যালেঞ্জ অনেক তীব্র হবে। অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল বলেন, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা সময়োপযোগী, সুচিন্তিত এবং অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে তরুণ শ্রমশক্তির কাজের ব্যবস্থা করা এখন সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দক্ষ করে শ্রম বাজারে পাঠানোও জরুরি।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের প্রয়োজন শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া দরকার। বিশেষ করে সবার জন্য উচ্চমানের যুগোপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সাজাতে হবে। কারণ শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজন বদলাচ্ছে এবং বদলাতে থাকবে। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আগামীতে উচ্চ আয়ের দেশ হবে। এই অভিযাত্রায় কী ধরনের দক্ষতা দরকার, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে দক্ষতার চাহিদা বদলাবে তা নিশ্চিত। এ জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেইভাবে সাজাতে হবে, যাতে অর্থনীতির প্রয়োজন মিটতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে একেবারেই দক্ষ জনশক্তি আসছে না, তা বলা ঠিক হবে না। তবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তরুণ-তরুণীরা বের হচ্ছে। কিন্তু বাজারে বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে কোন বিষয়ের কতজন লোকের চাহিদা আছে, সে বিষয়ে ধারণা অস্পষ্ট। এমনকি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। শ্রমশক্তির চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি দূর করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ দরকার।
আইএলওর সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, আয় বৈষম্যের কারণে শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে বিরাট বৈষম্য রয়েছে। খুব কম শিক্ষার্থীই ভালো মানের শিক্ষা পাচ্ছে। গ্রাম ও শহরের বৈষম্যও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তাই নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারকে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত আসছে। তাই শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কারিগরি ও বিশেষায়িত শিক্ষায় জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তার মাত্র তিন শতাংশ ভর্তি হয় কারিগরি শিক্ষায়। এক্ষেত্রে সরকারকে নজর দিতে হবে। অনেক উন্নত দেশে মাধ্যমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের বিশেষায়িত শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই এসব দেশে বেকারত্বও কম।
এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানুল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার চার থেকে সাড়ে চার শতাংশের মধ্যে। এই হার আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুযায়ী করা। উচ্চ আয়ের দেশে বেকারত্বের হার এমন হলে তারা উৎফুল্ল হয়ে প্রচার করতেন, সকলের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা গেছে। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, জরিপ করার আগের সপ্তাহে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ করেছেন এবং অন্য কোনো কাজ খোঁজেননি, এমন ব্যক্তি বেকার নন। বাংলাদেশে এমন কর্মক্ষম মানুষ নেই বললেই চলে, যিনি জীবিকার তাগিদে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করেননি। তাই এ দেশের মূল সমস্যা হলো, প্রচ্ছন্ন বেকার ও আয়ের বিচারে বেকারত্ব।
রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প খাতের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সেবা খাতেও নজর দিতে হবে। গতানুগতিক সেকেলে সেবা খাতের বদলে আধুনিক সেবা খাত বিকাশের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ খাতগুলোকে এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। চুক্তিভিত্তিক কাজের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক খাতে যে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হচ্ছে, তাকে নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে।
রিজওয়ানুল বলেন, বাংলাদেশের জনগণের বয়সভিত্তিক কাঠামো অনুযায়ী, এখানে তরুণ জনগোষ্ঠী বেশি, যা অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। কারণ এতে সমাজে নির্ভরশীলতার বদলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। অথচ দেশে ১৫ বছর থেকে ২৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ শ্রমবাজারে কমছে। ২০১৩ সালে এ বয়সের ৫৪ শতাংশ জনশক্তি ছিল শ্রমবাজারে, যা ২০১৬ সালে ৫০ ভাগে নেমেছে। তিনি বলেন, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশ বাড়াতে না পারলে জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামোর সুবিধা পাওয়া দুস্কর হবে। এজন্য নারীরা কী কী কারণে শ্রমবাজারে আসছে না, তা বিশ্নেষণ করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগের ফলে আরেক ধরনের সেবা খাত সম্প্রসারিত হবে।
বাজারে উদ্বৃত্ত শ্রম থাকায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা প্রকৃত মজুরি পান না বলে মনে করেন রিজওয়ানুল ইসলাম। তিনি বলেন, উদ্বৃত্ত শ্রম থাকলে শ্রমিকের দরকষাকষির সুযোগ কমে যায়। আবার অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আনুষ্ঠানিক খাতে আসতেও শ্রমিকরা নায্য মূল্য পান না। অনেক খাতে নূ্যনতম মজুরির ব্যবস্থা থাকলেও দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে মজুরি বাড়ে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শিল্প খাতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমেছে।
রিজওয়ানুল জানান, সবকিছুর মূলে রয়েছে বিনিয়োগ। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ নেই। আর বেসরকারি খাতকে এ ক্ষেত্রে আকৃষ্ট করতে সরকারকে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অবশ্য সরকার এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি করেছে। অনেক কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। আশা করা যায়, বেসরকারি খাত বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।