ক্লান্ত মন চাঙ্গা হয় আধ্যাত্মিক বিনোদনে
নিউজ ডেক্স
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:২৪ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার
বিনোদন বললেই একটি শ্রেণী নাক সিটকে বলেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’। ফতোয়া দিয়ে বসেন ‘কুল্লু লাঈবুন হারাম প্রত্যেক খেল তামাশাই হারাম’।
কিন্তু আমরা নবীজির (সা.) জীবন চরিত পাঠে দেখতে পাই তিনি মুখ গোমড়া করা ভাবধারা ভেকধরা বুজুর্গদের মতো ছিলেন না। তিনি ছিলেন যথেষ্ট সরস ব্যক্তিত্ব। চরম শত্রুর সঙ্গেও তিনি সহাস্যভাবে আলাপ করতেন।
তার কাছাকাছি যারা থাকতেন তাদের সঙ্গে তিনি হাস্য-কৌতুক করতেন বলেও বর্ণনা আছে। এক বুড়ি মহিলা এসে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার জন্য দোয়া করুন আমি যেন জান্নাতে যেতে পারি, নবী (সা.) বলেন কোনো বুড়ি জান্নাতে যাবে না। বুড়ি বলেন হায় হায় সেকি? হ্যাঁ তুমি যখন জান্নাতের উপযুক্ত হবে তখন যুবতী হয়েই জান্নাতে যাবে।
জান্নাত তো চিরযুবার স্বর্গোদ্যান। সেখানে কোনো বুড়াবুড়ি থাকবে না। এক দুস্থ সাহাবি এসে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আমার রুজি-রুটির জন্য বায়তুল মাল থেকে একটি উটের ব্যবস্থা করুন, যা ভাড়া দিয়ে আমার জীবিকা নির্বাহ হতে পারে।
তিনি খাজাঞ্চিকে বলেন, তার জন্য একটা উটনীর বাচ্চা নিয়ে এসো। সাহাবি বলেন, আমি বাচ্চা দিয়ে কী করব? আমার চাই ভারবাহী উট। নবী (সা.) বলেন, ‘উট কী কোনো উটনীর বাচ্চা নয়’? বালিকা বধূ হিসেবে মা আয়েশা (রা.) যখন তার সংসারে এলেন তখন তার খেলার পুতুলসামগ্রী নিয়ে এসেছেন এবং তা দিয়ে তার সখীদের সঙ্গে পুতুল খেলেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
এতে নবী (সা.) কোনো আপত্তি করেননি। যায়েদ ইবনুল হারেসা মা খাদিজার ক্রীতদাস হিসেবে নবীজির সংসারে এলে নবীজি তাকে আজাদ করে পালকপুত্র হিসেবে ঘোষণা দেন। তার পিতা তাকে নিতে এলে।
নবী (সা.) বলেন, তাকে আমি স্বাধীন করে দিয়েছি, সে স্বেচ্ছায় আপনাদের সঙ্গে যেতে চাইলে আমি বাধা দেব না। এই বলে নবী (সা.) যায়েদকে ডেকে বলেন, তোমার পিতা তোমাকে নিতে আসছে তোমার ইচ্ছা হলে চলে যেতে পার।
এ কথা শোনার পর যায়েদ একবার পিতার দিকে তাকায় আরেকবার পালক পিতা নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর দিকে তাকায়, শেষে বলে বাবা তুমি চলে যাও এই মহান ব্যক্তিত্বের যে পরশ পেয়েছি তাঁকে ছেড়ে তোমার সঙ্গে যাব না। যায়েদকে একদিন প্রয়োজনীয় হাতিয়ার প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে আনার জন্য কাজটি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন।
মিনিট যায়, ঘণ্টা যায় যায়েদ তো আসে না, পরে নবী (সা.) ওই বাড়ি যাওয়ার পথে দেখেন যায়েদ পথে সমবয়সী ছেলেদের খেলা দেখছে। তিনি তার পাশ দিয়ে মুচকি হেসে হাতিয়ার আনতে চলে যান।
যায়েদকে তার বালকসুলভ স্বভাবে ছেড়ে দেন। এটাই তো মানুষের ফিতরাত যে যে বয়সের তাকে সে বয়স মাফিক আনন্দ বিনোদনে উৎসাহ না দিলে গায়ে-গতরে বড় হলেও মানসিক বিকাশ ঘটে না।
আমরা আসলে নবী জীবনের এসব বিষয় আমলে আনতে ভুলে গেছি। দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এক সময় আনন্দ বিনোদনের তেমন ব্যবস্থাই ছিল না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। যার ধকল আমরা এখনও পোহাচ্ছি।
নবী (সা.) হলেন জগতের সমগ্র সৃষ্টিকুলের আইকন বা দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, ‘বুয়িস্তু লি উতাম্মিমা মাকারিমাল আখলাক্ব, আমাকে পাঠানো হয়েছে সৃষ্টিকুলের চারিত্রিক উৎকর্ষতা সাধন করতে। তাঁকে যে যেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে, তার জাগতিক ও আত্মিক খোরাক বা চাহিদা তার চারিত্রিক মাধুর্যে পেয়েছে।
ঈদের দি
নে মা আয়েশার (রা.) ঘরে তার কিশোরী বান্ধবীরা যখন দফ্ বাজিয়ে আনন্দ সঙ্গীত গাইছিল নবী (সা.) তখন নিষেধ করেননি বরং নীরবতা পালন করেছেন। ইসলামী ফিকাহ্-এর একটি উসুল বা নিয়ম হল ‘আসসুকুতু নির্স্ফুরিদ্বা’ বা মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। এ ধারাটি শুধু ইসলামে নয়, সব সমাজেই প্রযোজ্য।
সিদ্দিকে আকবর মেয়ে আয়েশাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে এসে এই দৃশ্য দেখে তিরস্কারের কারণে হঠাৎ মেয়েরা গীতনৃত্য থামিয়ে দিল নবীজি (সা.) বলেন, ‘আবু বকর আজ তো ঈদের দিন তাদের আনন্দ করতে দাও’। এই কথা শুনে মেয়েরা দ্বিগুণ উৎসাহে গাইতে থাকে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুফিদের একটি শ্রেণী গীতনৃত্যকে তাদের সাধনার অঙ্গ করে নিয়েছেন।
আমিরুল মোমেনিন আলী (রা.) বলেন, ‘শরীরকে কাজ কর্মের ধকলে যেমন ক্লান্ত-শ্রান্ত করে দেয়, মনও তেমনি বিভিন্ন কারণে বিতৃষ্ণ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই তোমরা মনকে চাঙা করার জন্য বিনোদন কৌশল তালাশ করো’। তিনি মনের ব্যাপারে আরও বলেন, মনকে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম দাও। কারণ মনকে লাগাতার কোনো চিন্তা-চেতনায় বাধ্য করে রাখলে মন অন্ধ হয়ে যায়’।
মানুষ সৌন্দর্যপ্রিয়। এটাই মানুষের সহজাত স্বভাব। এ জন্যই হয়তো এক গীতিকবিতায় বলা হয়েছে ‘মন দেখে কে কবে মন দিয়েছে? আমি তো রূপেই পাগল, রূপের ওই আগুনে মন না পোড়ালে মন তো খাঁটি হয় না- রূপসীর মনটা খাঁটি হোক বা না হোক কিছুই এসে যায় না’।
এসব পাগলের মনের লাগাম টেনে ধরতেই হয়তো নবী (সা.) তাদের কথা সামনে রেখেই বলেছেন ‘তুন্কাহুল মারআতা লি আরবাঈন’ মেয়েদের বিয়ে করো চারটি বিষয় দেখে ‘লি জামালিহা’ তার সৌন্দর্য, ‘লি মালিহা’ তার ধনসম্পদ দেখে, ‘ওয়া নাসাবিহা’ তার বংশমর্যাদা দেখে, ‘ওয়া দ্বীনিহা’ তার দ্বীনদারি বা পরহেজগারি দেখে, ‘ফাজ্ফার বিজাতিদ্দ্বীন’ আর দ্বীনদারিকেই প্রাধান্য দাও কারণ, এটাই চিরস্থায়ী আর সব ক্ষণস্থায়ী।
ইসলাম কখনই সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করেনি। বলা হয়েছে ‘আল্লাহু হুস্নুন’ আল্লাহ সুন্দর ‘ইউহিব্বুল হুস্না’ তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। ইসলামের ‘পঞ্চবেনা’র গুরুত্বপূর্ণ ‘বেনা’ হল নামাজ।
যাকে বলা হয় ‘মিফ্তাহুল জান্নাহ’ বা জন্নাতের কুঞ্জি। ‘সেই নামাজে আত্মিক ও দৈহিক সৌন্দর্য অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে ‘খুজু জিনাতাকুম ঈনদা কুল্লি সালাতিন’ প্রত্যেক নামাজে সাধ্যমতো সুন্দর পোশাক-আশাক ধারণ করে নাও।
কালামে পাকে আল্লাহ নবী (সা.) কে ডেকে বলেন, ‘ক্বুল মান হাররামা জিনাতাল্লাহি’ হে নবী বলুন কারা আল্লাহর সৌনন্দর্যকে হারাম করল? ‘আল্লাতি মিন ইবাদিহি রিজক্বিন’ আল্লাহ যা তার বান্দাদের দৈহিক ও আত্মিক জীবিকা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
অবকাশ-বিনোদন ও ইবাদতের সমন্বয় সাধন সম্পর্কে নবী (সা.) তার সাহাবি হানজালাকে (রা.) বলেন, ‘হে হানজালা কিছু সময় ইবাদতের জন্য আর কিছু সময় অবকাশ বা বিনোদনের জন্য রাখ।
হজরত উমর ফারুক (রা.) বলেন, ‘ওই সময় (খায়রুল কুরুনে) লোকেরা (আমাদের সাথী সাহাবির) হাসাহাসি করত অথচ ঈমান ছিল পাহাড়ের চেয়েও বেশি দৃঢ়’।
হজরত আবু দারদ্বা (রা.) বলেন, ‘আমি বৈধ এবং শুভ বিনোদনের মাধ্যমে আমার মনকে বিশ্রাম দিই যাতে সে দ্বীনে হক্বের ওপর আরও দৃঢ় হয়। সুতরাং যে বিনোদন থেকে স্রষ্টা বিস্মৃত থাকে না তা নিঃসন্দেহে বৈধ। আর বৈধ জিনিসকে হারাম বলা খোদার ওপর খোদকারী।