ইসলামে দেশপ্রেম ও বিজয় উদযাপন
নিজস্ব প্রতিবেদক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:০৫ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার
বছর ঘুরে ফিরে এলো বিজয় দিবস। বিজয় আনন্দে উচ্ছাসিত লাল সবুজের এ মাটি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের এ দিনে অর্জন হয়েছিল মহান বিজয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয়েছিল আমাদের এই দেশ, বাংলাদেশ। দেশের প্রতি মায়া-মামতা ও ভালোবাসা থেকে লাল সবুজের পতাকা হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন লাখো বাঙ্গালি। শহিদ হয়েছিল লাখো মায়ের সন্তান। যাদের বিনিময়ে আজকে আমাদের এ বিজয় উদযাপন।
ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্বও অত্যাধিক। প্রবাদ আছে, ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান’ দেশকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ বলে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিজ দেশ অর্থাৎ স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা চিরন্তন, শাশ্বত সত্য বলে ইসলামে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশ মেনে চল (সূরা নিসা : ৫৯)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দেশ রক্ষার্থে একদিন এক রাতের প্রহরা-ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারারাত ধরে ইবাদতে কাটিয়ে দেয়ার চেয়ে উত্তম (মুসলিম শরিফ)।
দেশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যে চোখ দেশের সীমান্ত রক্ষায় বিনিদ্র থাকে সে চোখকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না। মা-মাটি, মাতৃভাষা, দেশপ্রেম এত ইসলামের সুর।
আল্লাহর রাসূল নিজে স্বদেশকে ভালবেসে আমাদের জন্য নমুনা উপস্থাপন করে গেছেন। রাসূল (সা.) তার দেশ মক্কাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন, মক্কার জনগণকে ভালোবাসতেন। তাদের হেদায়াতের জন্য তিনি কঠোর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনোদিন মক্কাবাসীর অকল্যাণ পর্যন্ত কামনা করেননি। তায়েফে এত নির্যাতন করল তারপরও কোনো বদদোয়া করেননি।
মহানবী (সা.) সাহাবিদের কাফিরদের অত্যাচারে আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দিলেও তিনি মক্কায় নির্যাতন সহ্য করে অবস্থান করলেন। পরিশেষে কাফিরদের কঠিন ষড়যন্ত্রের কারণে এবং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তিনি যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন মক্কার দিকে বারবার ফিরে তাকান। আর কাতর কণ্ঠে বলেন, ও আমার দেশ, তুমি কত সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন জাতি যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।
সাহাবিরাও স্বদেশ ভূমি পবিত্র মক্কাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) মক্কা থেকে হিজরতের সময় বলেছিলেন, ‘হে মক্কা! আমাকে যদি এর অদিবাসী বের করে না দিত তাহলে আমি তোমার বুকেই বসবাস করতাম’।
আমরা আমাদের বিজয় এবং দেশপ্রেমকে যদি ইসলামের আলোকে দেখি তাহেলে আমরা দেখব এসবই আমাদের জাতির গৌরবের, আনন্দের, অহঙ্কারের, আত্মমর্যাদার। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বাধীন কোনো রাষ্ট্র ছিল না। হাজার বছরের বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল বাঙালি জাতির নিজস্ব আবাসভূমি।
এ বিজয় ছিনিয়ে আনতে দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। নিরস্ত্র বাঙ্গালী আতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা প্রায়। মুক্তির লক্ষ্যে শুরু বীর বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাভোগের মাধ্যমে অবশেষে অর্জিত হয় বিজয়। আজকের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল।
এ দিবসে আনন্দ উদযাপন ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বরং ইতিহাস বিকৃত না করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এ দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা জরুরি। পাশাপাশি দেশের বিজয়ের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মদানকারী সব শহিদদের স্মরণ ও দোয়া মুনাজাত করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঈমানের একান্ত দাবি।
যদিও বর্তমান সময়ে অনেকেই মনে করেন যে, বিজয় দিবস উদযাপন মানেই ইসলামের অবমাননা। বিষয়টি তা নয়; কারণ বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বিজয় দিবস উদযাপন করেছিলেন।
তিনি ইসলাম প্রচারের কারণে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিজরত করেছিলেন মদিনায়। দীর্ঘ ১০ বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর সফলতার সঙ্গে নিজ দেশ স্বাধীন করেন। অর্জন করেন মহান স্বাধীনতা ও বিজয়। নবীজী (সা.) মক্কা বিজয়ের আনন্দে প্রথমেই তিনি ৮ রাকাআত নামাজ আদায় করেছিলেন। আর তিনি এত অধিক পরিমাণে আনন্দ লাভ করেছিলেন যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়।
তাইতো মক্কা বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘যারা কাবা ঘরে আশ্রয় নিবে তারা নিরাপদ। এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নিবে; তারা যত অত্যাচার নির্যাতনকারীই হোক তারাও নিরাপদ। এ ছিল প্রিয়নবীর মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা।
দেশ প্রেম যেমন ঈমানের অঙ্গ, তেমিন দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেয়া আবশ্যক। বিজয় দিবসে দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্মানের সঙ্গে এ পতাকা উত্তোলন করাও ঈমানের দাবি। চাই হোক তা সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; হোক তা মাদরাসা আর হোক তা মসজিদ।
প্রিয়নবীর উল্লিখিত হাদিসটিই তো বাঙ্গালি জাতির বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘অল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত (দেশের) সীমানা পাহারা দেয়া এক রোজা পালন ও এক মাসব্যাপী রাত জাগরণ করে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। আর এ অবস্থায় যদি ওই ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করে; তবে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে; কবর ও হাশরে ওই ব্যক্তি ফেতনা থেকে মুক্ত থাকবে।’ (মুসলিম)