কুরআনের সংকলন ও বিন্যাসের ইতিহাস
ডেস্ক রিপোর্ট
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০১:৫১ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ. فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظٍ “বরং এটা মহান কুরআন, লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ।” –সূরা বুরুজ: ২১,২২
এরপর পবিত্র কুরআনের নাযিল ও সংরক্ষণের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ “নিশ্চয়ই আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি, আর আমি নিজেই এর সংরক্ষণকারী।” –সূরা হিজর: ৯
উপরের আয়াতগুলোতে আমরা দেখলাম আল্লাহ তাআলা নিজেই কুরআনকে অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনি নিজেই যে তাঁর গ্রন্থ কুরআনের সংরক্ষণ করবেন, এ কথা বলে দিচ্ছেন। যেন এ নিয়ে সত্যতা ও যে কোন প্রকার ভ্রান্তি থেকে এর পবিত্রতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন বা সংশয় সন্দেহের অবকাশ না থাকে।
পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআন বর্তমানে যে ধারাবাহিকতায় বিন্যস্ত, আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারেই তা রাসূল (সা.) এর হাতেই সম্পন্ন হয়েছে। যখনই কুরআন মাজীদের কোন সূরা বা সূরার অংশবিশেষ আল্লাহর রাসূল (সা.) এর উপর অবতীর্ণ হতো, তখনই আল্লাহর রাসূল (সা.) তার সাহাবীদের নির্দেশনা প্রদান করতেন, কুরআনের কোন অংশের সাথে নতুন অবতীর্ণ এই আয়াতসমূহ সংযোজিত হবে।
নামাজে বা অন্যান্য সময়ে কুরআন তেলাওয়াতে রাসূল (সা.) এই বিন্যাস বজায় রেখেই কুরআন তেলওয়াত করতেন। আল্লাহর রাসূলের সাহাবীরাও রাসূল (সা.) এর অনুসারে একই বিন্যাস বজায় রেখে কুরআন তেলওয়াত করতেন।
এটি ঐতিহাসিক সত্য যে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত কুরআন সংকলন অব্যাহত ছিল। কুরআন নাযিলের সমাপ্তির সাথে সাথে কুরআনের আয়াতের সংকলনের সমাপ্ত ঘটে। সুতরাং, কুরআনের বিন্যাস তখন যেভাবে সাজানো হয়েছিলো, এখনো সেই বিন্যাসেই কুরআন সজ্জিত। মুসলমানদের উপর যখন নামাজ আদায় করা ফরজ করা হয়, নামাজের মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত করা তখনও আবশ্যিক করে দেওয়া হয়। ফলে নামাজের প্রয়োজনে মুসলমানরা কুরআন মুখস্ত করা শুরু করেন। অনেকেই সম্পূর্ণ কুরআন মাজীদ তাদের স্মরণশক্তিতে গেঁথে নেন।
কুরআন সংরক্ষনের জন্য শুধু মানুষের স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করা হয়নি। বরং তখনই তা বিক্ষিপ্তভাবে গাছের পাতা, চামড়ার খন্ড, পাথর, পশুর হাড়, কাগজ ইত্যাদিতে লিখে রাখার মাধ্যমে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
কুরআন সংকলন
রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর সমগ্র আরবে বেদুইনদের ভেতর বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে। এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে রাসূল (সা.) এর এমন অনেক সাহাবীও শাহাদাত বরণ করেন, যাদের স্মরণশক্তিতে সম্পূর্ণ কুরআন গাঁথা ছিলো।
এরূপ অবস্থায় হযরত উমর (রা.) তৎকালীন খলীফা হযরত আবু বকর (রা.) এর কাছে মানুষের স্মরণশক্তির পাশাপাশি লিখিতভাবে কুরআনকে সংকলন করার জন্য প্রস্তাব পেশ করেন।
প্রথমে হযরত আবু বকর (রা.) বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তহীন ছিলেন। কেননা, রাসূল (সা.) তার জীবিত থাকাকালীন সময়ে এরূপ কোন আদেশ প্রদান করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হযরত উমর (রা.) এর সাথে একমত হয়ে তিনি লিখিতভাবে কুরআন সংকলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একাজের জন্য তিনি রাসূল (সা.) এর কাতেব হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা.) এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন।
তারা রাসূল (সা.) এর সময়কালীন লিখিত কুরআনের বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত লিখিত অংশ এবং কুরআনের হাফিজদের সহায়তায় সংকলনের কাজে অগ্রসর হন। দুটি উৎসের সমন্বয়ে তারা সতর্কভাবে কুরআন সংকলন করেন।
সংকলন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তা হযরত আবু বকর (রা.) কাছে সংরক্ষিত রাখা হয়। হযরত আবু বকর (রা.) এর ইন্তেকালের পর তা হযরত উমর (রা.) এর কাছে এবং তার শাহাদাতের পর এটি তার কন্যা ও রাসূল (সা.) এর স্ত্রী হযরত হাফসা (রা.) কাছে সংরক্ষিত করে রাখা হয়।
কুরআন যদিও কুরাইশদের উপভাষাতে অবতীর্ণ হয়েছিল, তথাপি প্রাথমিক যুগে আরব গোত্রগুলোকে তাদের নিজস্ব উপভাষায় কুরআন তেলাওয়াত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ইসলামের বিস্তারের সাথে সাথে আরবী ভাষারও বিস্তার ঘটে। ফলে কুরআনের ভাষার মধ্যে অন্যভাষার অনুপ্রবেশ ঘটার শংকা দেখা দিয়েছিলো। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তির আশংকা দেখা দিয়েছিল।
এর ফলে হযরত উসমান (রা.) এর সময়কালে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, হযরত আবু বকর (রা.) এর সময়ে সংকলিত কুরআনকে একমাত্র পাঠ্য হিসেবে রাখার এবং অন্যান্য উপভাষার কুরআন সমূহ পরিত্যক্ত করার। তিনি হযরত হাফসা (রা.) এর কাছে সংরক্ষিত আবু বকর (রা.) এর সংকলিত কুরআনটি নিয়ে এর আরো প্রতিলিপি তৈরি করেন এবং মুসলিম খেলাফতের বিভিন্ন স্থানে তা প্রেরণ করেন। একইসাথে এই প্রতিলিপি ব্যতীত কুরআনের অন্যান্য প্রতিলিপি সমূহ তিনি বিনষ্ট করার জন্য আদেশ প্রদান করেন। বর্তমানে আমাদের হাতে কুরআনের যে প্রতিলিপি বিদ্যমান, তা হযরত আবু বকর (রা.) এর সংকলিত এবং হযরত উসমান (রা.) নকলকৃত কুরআনের কপিরই প্রতিলিপি। হযরত উসমান (রা.) এর নকলকৃত কুরআনের কপিসমূহের মধ্যে অনেকগুলো কপিই বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত আছে।