সন্তানের প্রতি লোকমান হাকীমের ১১ উপদেশ (প্রথম পর্ব)
ডেস্ক রিপোর্ট
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০১:৫৭ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার
আমাদের কোমলমতি শিশুরাই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। শিশুদের বাল্যকালের শিক্ষা-দীক্ষা যদি ভালো হয়, তবে আশা করা যায় তাদের ভবিষ্যৎ ও আগামী পৃথিবীর বিনির্মাণ ভালো হবে। দেশ, জাতি, সমাজ নির্বিশেষে পুরো পৃথিবী তাদের দ্বারা লাভবান ও উপকৃত হবে। এজন্য শিশুদের শিক্ষা, তালিম, তরবিয়ত ও তাদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দেয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এ কারণেই আমরা কুরআনে কারীমে দেখতে পাই যে, মহান আল্লাহ তা’আলা শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার দায়িত্ব সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে লোকমান হাকিমের ঘটনা সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ ঘটনায় লোকমান হাকিম তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য যে, মহান আল্লাহ তা’আলা তা কুরআন কারীমে সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মত এটা তিলাওয়াত করবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ উপদেশ হবে উম্মাহর সকল সদস্যের জন্য আদর্শ। এ নিবন্ধে ইনশাআল্লাহ, কুরআনের সে আলোচনাই তাফসিরে ইবনে কাসিরের ব্যখ্যাসহ পাঠক সমীপে দুই পর্বে পেশ করা হবে। আজ প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হচ্ছে—
লোকমান (আ.) তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন তা নিম্নরূপ:
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ
অর্থ, ‘আর স্মরণ কর, যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল...।’
এ উপদেশগুলো ছিল অত্যন্ত উপকারী, যে কারণে মহান আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমে লোকমান হাকিমের পক্ষ থেকে উল্লেখ করেন।
প্রথম উপদেশ:
তিনি তার ছেলেকে বলেন,
يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
অর্থ, ‘হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক কর না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।’
এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথমে তিনি তার ছেলেকে শিরক হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। একজন সন্তান তাকে অবশ্যই জীবনের শুরু থেকেই আল্লাহর তাওহিদে বিশ্বাসী হতে হবে। কারণ, তাওহিদই হলো, যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার একমাত্র মাপকাঠি। তাই তিনি তার ছেলেকে প্রথমেই বলেন, আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করা হতে বেঁচে থাক। যেমন, মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা অথবা অনুপস্থিত ও অক্ষম লোকের নিকট সাহায্য চাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এছাড়া এ ধরনের আরো অনেক কাজ আছে, যেগুলো শিরকের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দোআ হলো ইবাদত’ الدعاء هو العبادة সুতরাং আল্লাহর মাখলুকের নিকট দোআ করার অর্থ হলো, মাখলুকের ইবাদত করা, যা শিরক।
মহান আল্লাহ তা’আলা যখন তার বাণী,
وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ
অর্থাৎ ‘তারা তাদের ঈমানের সাথে যুলুমকে একত্র করেনি।’ এ আয়াত নাযিল করেন, তখন বিষয়টি মুসলিমদের জন্য কষ্টকর হলো এবং তারা বলাবলি করল যে, আমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে তার উপর অবিচার করে না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আলোচনা শুনে বললেন,
ليس ذلك ، إنما هو الشرك ، ألم تسمعوا قول لقمان لابنه :يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
অর্থাৎ, ‘তোমরা যে রকম চিন্তা করছ, তা নয়, এখানে আয়াতে যুলুম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, শিরক। তোমরা কি লোকমান (আ.) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছে, তা শোননি? তিনি তার ছেলেকে বলেছিলেন,
يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ .
অর্থ, হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক কর না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।’– সুরা লোকমান:১৩
দ্বিতীয় উপদেশ:
মহান আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ .
অর্থ, ‘আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে [সদাচরণের] নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে, তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।’ - সুরা লোকমান: ১৪
তিনি তার ছেলেকে কেবলই আল্লাহর ইবাদত করা ও তার সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করতে নিষেধ করার সাথে সাথে মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার উপদেশ দেন। কারণ, মাতা-পিতার অধিকার সন্তানের উপর অনেক বেশি। মা তাকে গর্ভধারণ, দুধ-পান ও ছোট বেলা লালন-পালন করতে গিয়ে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট সইতে হয়েছে। তারপর তার পিতাও লালন-পালনের খরচাদি, পড়া-লেখা ও ইত্যাদির দায়িত্ব নিয়ে তাকে বড় করছে এবং মানুষ হিসেবে ঘড়ে তুলছে। তাই তারা উভয় সন্তানের পক্ষ হতে অভিসম্পাত ও খেদমত পাওয়ার অধিকার রাখে।
তৃতীয় উপদেশ:
মহান আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমে মাতা-পিতা যখন তোমাকে শিরক বা কুফরের নির্দেশ দেয়, তখন তোমার করণীয় কি হবে তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
অর্থ, ‘আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে করবে সদ্ভাবে। আর আমার অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।’ - সুরা লোকমান: ১৫
আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘যদি তারা উভয়ে তোমাকে পরি-পূর্ণরূপে তাদের দ্বীনের আনুগত্য করতে বাধ্য করে, তাহলে তুমি তাদের কথা শুনবে না এবং তাদের নির্দেশ মানবে না। তবে তারা যদি দ্বীন কবুল না করে, তারপরও তুমি তাদের সাথে কোনো প্রকার অশালীন আচরণ করবে না। তাদের দ্বীন কবুল না করা তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাতে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। তুমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করবে। আর মুমিনদের পথের অনুসারি হবে, তাতে কোনো অসুবিধা নাই।’
এ কথার সমর্থনে আমি বলব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীও বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট ও শক্তিশালী করেন, তিনি বলেন,
« لا طاعة لأحد في معصية الله ، إنما الطاعة في المعروف »
‘আল্লাহর নাফরমানিতে কোনো মাখলুকের আনুগত্য চলবে না। আনুগত্য-তো হবে একমাত্র ভালো কাজে।’
চতুর্থ উপদেশ:
লোকমান হাকিম তার ছেলেকে কোনো প্রকার অন্যায় অপরাধ করতে নিষেধ করেন। তিনি এ বিষয়ে তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন, মহান আল্লাহ তা’আলা কুরআনে তার বর্ণনা দেন। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ .
অর্থ, ‘হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষা দানার পরিমাণও হয়, অতঃপর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমান সমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ।’ - সুরা লোকমান: ১৬
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, অন্যায় বা অপরাধ যতই ছোট হোক না কেন, এমনকি যদি তা শস্য-দানার সমপরিমাণও হয়, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা’আলা তা উপস্থিত করবেন এবং মীযানে ওজন দেয়া হবে। যদি তা ভালো হয়, তাহলে তাকে ভালো প্রতিদান দেয়া হবে। আর যদি খারাপ কাজ হয়, তাহলে তাকে খারাপ প্রতিদান দেয়া হবে।