‘গিবতকারী নিজের নখ দ্বারা চেহারার গোশত ছিঁড়ে ফেলবে’
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৬:১৮ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
ইমাম নববী (রহ.) ওই সমস্ত গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যা জবান দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে। এরপর সর্বপ্রথম ওই গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যা সচরাচর হয়ে থাকে। আর তা হলো গিবত।
গিবত বিশেষ করে যেকোনো মজলিসে ব্যপাকভাবে ছেয়ে গেছে। মানুষের চলা-ফেরা ওঠা-বসার মধ্যে প্রায় সব জায়গায় এই গিবত হয়ে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিবতের কঠিন ভয়াবহতা সম্পর্কে বলে গেছেন। কোরআনুল কারীমে গিবতের বিষয়ে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। অন্যান্য গুনাহের ব্যাপারে এতটা কঠিনভাবে উল্লেখ করা হয়নি। যেমন,
وَلا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ
‘তোমরা পরস্পর গিবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি নিজের মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ কর? অথচ এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ।’
কাজেই একথা গভীরভাবে চিন্ত করা উচিত। গিবতের পরিণাম কত নিকৃষ্ট। মানুষের গোশত খাওয়া? তা-ও নিজের ভাইয়ের? জীবিত না বরং মৃত ভাইয়ের। এতটাই নিকৃষ্টতা জেনে বুঝে কেউ কী করতে পারে?
গিবতের পরিচিতি:
গিবতের কী অর্থ? গিবতের অর্থ হলো- কারো পেছনে অগোচোরে তার দোষ বর্ণনা করা। চাই ওই দোষ তার মাঝে থাকুক বা না থাকুক। যদি ওই দোষ সত্যিকারার্থে তার মাঝে থেকে থাকে, তাহলেও তা গিবত হবে। হাদিসে এসেছে- সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন- গিবত কী? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন
ذكرك اخاك بما يكره
‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে তার অগোচরে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করেন।’
অর্থাৎ এই কথাগুলো তার সামনে বলা হলে সে মনে কষ্ট পেত কিংবা অপছন্দ করত। এটাই হলো গিবত।
সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
ان كان في اخي ما اقول
যদি ওই দোষ-ত্রুটিগুলো তার মধ্যে বিদ্যমান থেকে থাকে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তবু এটা গিবত। যদি ওই দোষ-ত্রুটি তার সঙ্গে না থাকে তা হলে মিথ্যা বলার অপরাধে গুনাহ হবে। বিভিন্ন মজলিসে পরস্পর দেখা সাক্ষাতে এধরনের বহু কথা আমরা বলে ফেলি যা গিবতের অন্তর্ভুক্ত। অনেকেই আবার বলে থাকেন, একথা আমি তার সামনেও বলতে পারব। কাজেই এটা গিবত হবে না। তাদের এ কথা ঠিক নয়। অবশ্যই অবশ্যই তা গিবতে শামিল।
গিবত গুনাহে কবিরা:
গিবত অতিশয় মারাত্মক গুনাহ। মদ পান করা, গালি দেয়া, মন্দ কর্ম করা ইত্যাদি যদিও গুনাহে কবিরা তথাপি গিবত এমন গুনাহে কবিরা যা বান্দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে তার খারাবি অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ অন্যান্য কবিরা গুনাহ করে আল্লাহর নিকট মাফ চাইলে তিনি মাফ করতেও পারেন। কিন্তু বান্দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুনাহ বান্দা থেকে মাফ চেয়ে তারপর আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে। বান্দা যদি মাফ না করেন তা হলে আল্লাহ তায়ালা ওই গিবতকারীকে কিছুতেই মাফ করবেন না। কাজেই যেসব মজলিসে গিবত হয় ওই সব মজলিসে বসবে না। গিবতকারী গিবত শ্রবণকারী; উভয়েই সমান অপরাধী। কাজেই গিবত থেকে আমাদের সকলের বেঁচে থাকা উচিত। কেউ যদি আপনার নিকট গিবত করতে চায় তা হলে আপনি তাকে গিবত বলা থেকে বিরত রাখবেন।
গিবতকারী নিজের নখ দ্বারা চেহারার গোশত ছিঁড়ে ফেলবে:
হজরত আনাস (রাদি.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট খাদেম ছিলেন। তিনি দশ বৎসর পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মেরাজে গিয়ে ছিলেন তখন তিনি এমন একজন ব্যক্তি দেখতে পেলেন যে ব্যক্তি নিজ হাতের নখ দ্বারা চেহারার গোস্ত তুলে নিচ্ছে। আর সে হলো, গিবতকারী।
গিবত যিনা থেকেও মারাত্মক:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের নিকট নানাভাবে গুনাহসমূহের কথা আলোচনা করেছেন। এগুলো আমাদের সামনে থাকা উচিত, যাতে এগুলোর খারাবি আমাদের অন্তরে এসে যায়। হাদিসে গিবত করাকে যিনার চাইতেও মারাত্মক বলা হয়েছে। যদিও এ রেওয়ায়েতটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। কিন্তু হাদিসের অর্থটুকু সম্পূর্ণ সহিহ। কেননা কোনো ব্যক্তি যিনা করার পর লজ্জিত হয়ে ক্ষমা বা তাওবা করলে আল্লাহ পাক মাফ করে দিতে পারেন। অথচ গিবতকারী গিবতকৃত ব্যক্তির নিকট থেকে মাফ চেয়ে তাওবা না করলে বা ওই ব্যক্তি মাফ না করলে আল্লাহ তায়ালাও ওই ব্যক্তিকে মাফ করবেন না। গিবত করা কতইনা নিকৃষ্ট।
গিবতকারীকে জান্নাতে যেতে বাঁধা প্রদান করা হবে: গিবতকারী চাই প্রকাশ্যে যতই নামাu, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত করুক না কেন সে যখন পুলসিরাত পার হতে যাবে (পুলসিরাত হলো জাহান্নামের উপর নির্মিত বিশাল একটি পুল। জান্নাতে যেতে হলে এ পুলটি অতিক্রম হয়ে যেতে হবে। যারা জাহান্নামী হবে তারা এটা অতিক্রম করতে গেলে কেটে ফেটে জাহান্নামের গর্তে পড়ে যাবে।) তখন ফেরাশতারা ওই গিবতকারীকে পুলসিরাত অতিক্রম করতে দেবে না। বলা হবে যতক্ষণ পর্যন্ত ওই গিবত মাফ নিয়ে না আসো ততক্ষণ তোমাকে পুলসিরাতের পুল অতিক্রম করতে দেয়া হবে না। যতক্ষণ না মাফ নিয়ে না আসবে ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
সুদের চাইতেও মন্দ কাজ হলো গিবত:
এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সুদ এতটাই জঘণ্যতম গুনাহ যার মাঝে অসংখ্য অগণিত গুনাহ রয়েছে। তন্মদ্ধে উল্লেখযোগ্য হলো- নিজের মায়ের সঙ্গে অপকর্ম করার সমতূল্য গুনাহ। দেখ! সুদের ব্যাপারে কত মারাত্মক ধমকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এর চাইতেও জঘণ্য হলো- কোনো ব্যক্তির ইজ্জত আব্রুর ওপর হামলা করা তথা গিবত করা।
গিবত করা মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া তুল্য:
এক রেওয়ায়েতে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় দু’জন মহিলা রোজা রাখা অবস্থায় পরস্পর বিভিন্ন কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তাদের কথাবার্তা গিবত পর্যন্ত পৌঁছে গেল। কিছুক্ষণ পর একজন সাহাবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট খবর নিয়ে এলেন, হে রাসুল! ‘দু’জন মহিলা রোজা রেখে ছিল, এখন তাদের অবস্থা খুব খারাপ। পিপাসায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লালাম অহীর মাধ্যমে মহিলা দু’জনের গিবত সম্পর্কে জেনে গেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলা দু’জনকে নিয়ে আসতে বললেন।
তাদের নিয়ে আসা হলো। তিনি দেখতে পেলেন মহিলা দু’জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাৎ একটি বড় পেয়ালা আনতে বললেন, পেয়ালা নিয়ে আসার পর তাদের একজন মহিলাকে পেয়ালার মধ্যে বমি করতে বললেন। ওই মহিলা বমি করল। তাতে দেখা গেল বমির মধ্যে রক্ত এবং তাজা গোশতের টুকরা রয়েছে। অতঃপর দ্বিতীয় মহিলাকে অনুরূপ করতে বললে সেও তা করল। অনুরূপ তার মুখ থেকেও রক্ত বমি এবং তাজা গোশতের টুকরা বের হয়ে এল।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এরা দু’জন যাদের গিবত করেছে এই গোশতগুলো তাদের। তারা উভয়ে রোজা রাখা অবস্থায় হালাল খাদ্য বর্জন করেছে ঠিক কিন্তু অপর ব্যক্তির হারাম রক্ত, গোশত খেয়েছে। যাদ্দরুন দু’জনের পেট হারাম রক্ত ও গোশত দ্বারা ভরে গিয়েছিল। তাই তাদের এ অবস্থা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন কখনো তারা গিবত না করে তাই আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা সংঘটিত করেছেন। আসলে আমাদের ইচ্ছা শক্তি খারাপ হয়ে যাওয়ায় দিল থেকে গুনাহের খারাবি চলে গেছে। তবে যে সব বান্দাদেকে আল্লাহ পাক বুঝ দান করেছেন তারা গুনাহ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন।
গিবত করার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কিত একটি শিক্ষণীয় স্বপ্ন:
এক তাবেয়ি ছিলেন যার নাম রিবঈ। তিনি বর্ণনা করেন, একদা আমি এক স্থানে গেলাম, সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম- লোকেরা কথোপকথন করছে। আমিও সেখানে বসে গেলাম। এক পর্যায়ে সেখানে গিবত শুরু হয়ে গেল। আমার নিকট এ অবস্থাটা অপছন্দনীয় মনে হলে আমি সেখান থেকে উঠে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমার ধারণা হলো হয়তো সেখানে আর গিবত হচ্ছে না তাই সেখানে গিয়ে আবার বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক কথা-বার্তা হওয়ার পর আবারো গিবত শুরু হয়ে গেল। তবে এখন আমার হিম্মত কমে যাওয়ায় মজলিস থেকে আর উঠলাম না। এখন আমি তাদের এ গিবত শুনতে লাগলাম। যখন মজলিস শেষ হলো আমি বাড়িতে গেলাম। রাতে শোয়ার পর স্বপ্নে দেখতে পেলাম- কালো একজন ব্যক্তি পেয়ালা করে আমার জন্যে বড় পেয়ালা ভর্তি গোশত নিয়ে এলো। আমি ভালোভাবে তাকিয়ে দেখতে পেলাম সেগুলো শুকরের গোশত। ওই ব্যক্তি আমাকে বললেন, গোশতগুলো খাও! আমি বললাম- শুকরের গোশত কীভাবে খাবো? আমি তো মুসলমান! কীভাবে শুকরের গোশত খাবো?
লোকটি বলল- এগুলো তোমাকে খেতেই হবে। এরপর জবরদস্তি করে গোশতের টুকরা হাতে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। আমি যতই বাধা সৃষ্টি করছি, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সে গোশতের টুকরা আমার মুখে পুরে দিতে চেষ্টা করছে। এমনকি আমার মুখে বমি চলে আসছিল। তথাপি সে থামল না। এমন কঠিন অবস্থায় হঠাৎ আমার ঘুম ভাঙ্গল। এদিকে ঘুম থেকে ওঠার পর খানার সময় যখন আমি খেতে লাগলাম, তখন খাবার মধ্যে থেকে স্বপ্নের মধ্যে শুকরের গোশতের যে দুর্গন্ধ ছিল তা অনুভব হতে লাগল। এমনকি যখন যা কিছু খেতে ইচ্ছে করি তাতেই ওই দুর্গন্ধ অনুভব হতে লাগল। তিন দিন পর্যন্ত এ দুর্গন্ধ আমার অনুভব হচ্ছিল। এ ঘটনার পর আমার অন্তরে ভেদ হলো- আমি কিছুদিন পূর্বে গিবত করেছিলাম। যার অনুভূতি আমি তিন দিন পর্যন্ত অনুভব করেছিলাম।