দুদক আতঙ্কে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কোটিপতি স্ত্রীরা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১১:৪২ এএম, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সোমবার
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে কাস্টমসে দুর্নীতিবাজদের ধরতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক কর্মকর্তারা। তাই এসব দুর্নীতিবাজদের কোটিপতি স্ত্রীদের দিন কাটছে দুদক আতঙ্কে।
জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ঘিরে ৫৫টি মামলা, ৮২টি অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। এসব মামলার অধিকাংশ আসামি এ হাউজের কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রীরা।
আরো জানা গেছে, গত ১০ জানুয়ারি ৬ লাখ ঘুষের টাকাসহ চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনকে গ্রেফতার করে দুদকের চট্টগ্রাম জেলার সমন্বিত টিম। এরপর গত ১৬ জানুয়ারি ও ২২ জানুয়ারি দুই দফায় একদিন করে রিমান্ডে থাকা নাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলে বলে জানায় দুদক।
নাজিম উদ্দিন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী ও স্বজনরা গা ঢাকা দেন। তাদের ভেতরে রয়েছে গ্রেফতার আতংক। এর আগে চট্টগ্রামে কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী এবং তার স্ত্রী হালিমার বিরুদ্ধে গত ৬ জানুয়ারি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করে দুদক।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আমজাদের স্ত্রী গৃহিণী হলেও তিনি ৩ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ১০ কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৯ মে কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল মমিন মজুমদারকে গ্রেফতার করে দুদক। তার বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, আবদুল মমিন মজুমদার এবং তার স্ত্রী সেলিনা জামান পরস্পর যোগসাজশে এক কোটি ২৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
একই বছরের মে মাসে ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক আপ্রেইজার আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারের বিরুদ্ধেও মামলা করে দুদক। সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ শাখার সুপারিনটেনডেন্ট মনজুরুল হক চৌধুরীর স্ত্রী আকতার জাহান লাইলীর বিরুদ্ধেও মামলা করে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, বৈধ কোনো আয়ের উৎস না থাকা সত্ত্বেও দেড় কোটি টাকার মালিক বনেছেন গৃহিণী রাফেয়া বেগম। তার স্বামী চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের একজন কর্মচারী। একইভাবে আড়াই কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্মচারী এসএম জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী রাফেয়া বেগম ওরফে নাজমা হায়দার রাফিয়ার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলারও তদন্ত করছে দুদক।
এদিকে পরিবারের ১১ জনের নামে সাড়ে ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার শরীফ আল আমীনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে মামলা করেছে দুদক। এ মামলায় আল আমীনের স্ত্রীসহ তার পরিবারের ১১ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের সাবেক উচ্চমান সহকারী রফিকুল ইসলাম পাটোয়ারি ও তার স্ত্রী শাহীনের বিরুদ্ধে দুদকের দায়েরকৃত মামলায় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৮৮ লাখ ৯০ হাজার ৫৯৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।
এছাড়াও কাস্টম কর্মকর্তা আবদুল মমিন মজুমদার ও তার স্ত্রী সেলিনা জামান পরস্পর যোগসাজশে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। এছাড়াও ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৮৫৮ টাকার সম্পদ গোপনের অভিযোগ থাকায় দুদক তাদেরকে গ্রেফতার করে।
একইভাবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি এসএম জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী রাফেয়া বেগম ওরফে নাজমা হায়দার রাফিয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি মামলা চলছে। এ দম্পতির বিরুদ্ধে মোট আড়াই কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত উপার্জন করার অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অফিস সুপারভাইজার পদে চাকরি করা এসএম জাহাঙ্গীর আলম খুলনার ফুলতলায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই ইউনিটের চারতলা বাড়ি এবং গ্রামে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একতলা আরো একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এছাড়া তার নিজ নামে খুলনায় প্রায় ১৪ লাখ টাকার জমি রয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে উচ্চমান সহকারী পদে থেকেই জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রাফেয়া বেগম দেড় কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে খুলনার সোনাডাঙ্গায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি তিনতলা ভবন, ৭৭ শতাংশ জমি ও সাড়ে ৫ লাখ টাকায় কেনা টয়োটা গাড়ি।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সাবেক অ্যাপ্রেইজার আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারের বিরুদ্ধেও ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ এবং ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৩২০ টাকার সমপরিমাণ সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে দুদক।
এদিকে প্রায় ৫৪ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং প্রায় ১৪ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অপরাধে আকতার জাহান লাইলী নামে এক গৃহবধূর বিরুদ্ধে মামলা চলছে দুদকে। লাইলী চট্টগ্রাম কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ শাখার সুপারিনটেনডেন্ট মনজুরুল হক চৌধুরীর স্ত্রী।
স্ত্রী, মা, বোনসহ পরিবারের ১১ জনের নামে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার শরীফ মো. আল আমীনের বিরুদ্ধে গত বছর মামলা করেছে দুদক। এ মামলায় আল আমীন ছাড়াও তার মা শরীফ হাসিনা আজিম, বোন শরীফা খানম, স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা, তাদের আত্মীয় সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার রেজওয়ানুল হক, রাবেয়া আক্তার, ছালেহা বেগম, এসএম খাইরুলল আলম, কাজী নাদিমুজ্জামান, এমএম হুমায়ুন কবির ও ফাতেমা বাচ্চুকে আসামি করা হয়।
কাস্টমসে চাকরির মাত্র আড়াই বছরের মধ্যেই আল আমীন সোনালী ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় নিজ নামে ৮০ লাখ টাকার এফডিআর, তার মা শরীফ হাসিনা আজিম ও বোন শরীফা খানমের নামে ৭৫ লাখ টাকা করে দুটি এফডিআর করেন। তিনি ৩৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকায় একটি গাড়িও কেনেন। আল আমিন অবশিষ্ট অবৈধ সম্পদ রাখেন পরিবারের অন্য নিকটাত্মীয়দের নামে।
এদিকে কাস্টমস কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী ও ছেলের বিরুদ্ধেও চলছে দুর্নীতি মামলা। পরস্পর যোগসাজশে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।