দেশের প্রধান তেলবীজ সরিষা : অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প
স্বাস্থ্য ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৯:৩৪ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ বুধবার
কয়েক দশক আগেও দেশের রান্নায় ব্যবহৃত তেল বলতে সরিষাকেই বোঝাত। কালের পরিক্রমায় অন্যান্য তেলবীজের আগমনে সরিষার ব্যবহার কমে গেলেও এখনো দেশে উৎপাদিত তেলবীজগুলোর মধ্যে প্রধানতম হিসেবে বিবেচিত সরিষা। সারা দেশে এখনো তেলবীজ উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির সিংহভাগই ব্যবহার হয় সরিষা উৎপাদনে।
সরিষার ব্যবহার শুধু বীজ থেকে তেল উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়। এ গাছের পাতা শাক হিসেবে রান্না করা যায়, যা অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। সরিষার তেল রান্নার পাশাপাশি আচার বা চাটনি তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া আমাদের দেশে শরীরে ও মাথায় ব্যবহার্য তেল হিসেবেও সরিষার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশেষ করে ঠাণ্ডা থেকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য শিশুর গায়ে সরিষার তেল মাখার প্রবণতা এখানকার মায়েদের মধ্যে কমবেশি দেখা যায়। শুধু তেল উৎপাদনে নয়, মসলা হিসেবেও ব্যবহার হয় সরিষা। সরিষা বাটা দিয়ে রান্না করা ইলিশ এখানে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার। সরিষার ঝাঁজে ঝাঁঝালো ঝালমুড়ি নাশতা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া সরিষা থেকে আহরিত মধুও অত্যন্ত সুস্বাদু ও বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া সরিষার শুকনো গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া সরিষার খইল পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবেও বেশ পুষ্টিকর ও জনপ্রিয়। ভেষজ গুণাগুণের জন্য অত্যন্ত প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে এর ব্যবহার করে আসছেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরাও।
দেশে তেলবীজ হিসেবে সরিষা ব্যবহারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার অব্দেও সরিষা ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। শুধু উপমহাদেশ নয়, সমসাময়িক কালের সুমেরীয় লিপি থেকে ওই অঞ্চলেও তেলবীজটি ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় সরিষার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় ছিল। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে সরিষাকে বর্ণনা করা হয়েছে বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে। কিংবদন্তির গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রাতেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০ অব্দ) ও তার সমসাময়িক চিকিৎসকদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য তেলবীজটি ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে। ধারণা করা হয়, চীনে ও আফ্রিকায় সরিষা ব্যবহারের প্রচলিত রয়েছে যিশুর জন্মের অনেক আগে থেকেই। তবে অনেকেরই দাবি, সরিষার উত্পত্তিস্থল মূলত এশিয়াতেই। পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে এখনো বুনো সরিষা ও সরিষার সবচেয়ে কাছাকাছি আত্মীয় বুনো মুলা ও বুনো শালগম জন্মাতে দেখা যায়। এ থেকে অনেকেই ধারণা করছেন, এ অঞ্চলেরই কোনো এক স্থানে প্রথমবারের মতো ব্যবহার শুরু হয়েছিল সরিষার।
সরিষার ভেষজ ও পুষ্টিগুণ: সরিষায় প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন-ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। ঔষধি গুণাগুণের জন্য সুপ্রাচীন আমল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় বহুলভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে এ তেল। সাম্প্রতিককালে জার্মানিভিত্তিক এক গবেষণায়ও উঠে আসে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে সরিষার তেল অত্যন্ত কার্যকর। রোগের জীবাণু ধ্বংসকারী হিসেবে সরিষা তেলের এ গুণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এখন একমত। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহারজনিত কারণে সুপারবাগের সংক্রমণ যখন বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প ভেষজ ওষুধ হিসেবে এর কার্যকারিতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে স্বস্তি দেয়ার মতো খবর। প্রাকৃতিক হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে সরিষার তেল ব্যবহারের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। এছাড়া শ্বাসনালি, মূত্রনালি ও ব্রঙ্কাইটিস ইনফেকশন সারানোয় এটি বেশ ভালো ভূমিকা রাখে বলে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া সরিষার তেলের উপাদান দেহে ফুসফুস ও অন্ত্রের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ার (গাট ব্যাকটেরিয়া) কোনো ধরনের ক্ষতি না করেই কিডনির মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে নিষ্কাশিত হয়। এ কারণে এ তেল বৃহদান্ত্রের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি ও হজমে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত।
এছাড়া দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করার মাধ্যমে হূদরোগের ঝুঁকি কমায় সরিষার তেল। এছাড়া অনিদ্রা দূর করায়ও এটি অনন্য। সম্ভবত ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো’র বাগধারাটি এখান থেকেই উদ্ভূত। এছাড়া এর ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে বলেও মনে করা হয়। শ্বাসকষ্টের প্রদাহ কমানো, খুসখুসে কাশি, ঠাণ্ডা লাগা, সর্দি ইত্যাদির চিকিৎসায় সরিষার তেলের ব্যবহার সুপ্রাচীন। এছাড়া দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি ও হজমশক্তি বাড়ানোতেও এটি বেশ কার্যকর হিসেবে বিবেচিত। বলা হয়, দেহে পাচক রসের নিঃসরণ বাড়ানোর মাধ্যমে হজমশক্তি ও ক্ষুধাবর্ধকের কাজ করে সরিষার তেল।
আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে দাদ বা শ্বেতীয়র চর্মরোগের চিকিৎসায় সরিষা ব্যবহারের প্রচলন পাওয়া যায়। এছাড়া ফাইলেরিয়া, স্নায়ু সংকোচন, অগ্নিমান্দ্য, বাত, মাম্পস, কুষ্ঠ ও শ্লেষ্মার চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা হয়। গলার ভেতরে ঘা হলে বাইরে এ তেল ম্যাসাজ করার মাধ্যমে উপশম পাওয়া সম্ভব। আয়ুর্বেদে বলা আছে, সরিষার তেল সংক্রামক দোষ নষ্ট করে ও পচন রোধ করে। এছাড়া শ্বাসরোগের ক্ষেত্রে গুড়ের সঙ্গে সরিষার তেল মিশিয়ে খাওয়ার নিদানও দেয়া রয়েছে আয়ুর্বেদে। এটি নাকের বদ্ধভাব দূর করার ক্ষেত্রেও বেশ কার্যকর। এছাড়া দাঁতের চিকিৎসা ও মজবুত করার কাজেও এটি ব্যবহার করা হয়। বধিরতার চিকিৎসা ও কানের ব্যথায় ড্রপ হিসেবে এক-দুই ফোঁটা সরিষার তেল ব্যবহারেরও নিদান দেয়া রয়েছে আয়ুর্বেদে।
সরিষা তেলে প্রচুর বিটা ক্যারোটিন রয়েছে। এ কারণে মাথার তালুতে নিয়মিত ম্যাসাজ করা হলে তা নতুন চুল গজানোয় সহায়ক ভূমিকা রাখে। এছাড়া মাথাব্যথা কমানো, শুষ্ক ত্বক মসৃণ ও কোমল করা, ত্বকের প্রদাহ উপশম ইত্যাদিতেও বেশ কার্যকর বিবেচিত সরিষা তেল। এছাড়া এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করায়ও বেশ সহায়ক।
বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। এর খইলে আমিষ থাকে প্রায় ৪০ শতাংশ। এ কারণে তা গবাদিপশু ও মাছের জন্যও বেশ পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত।
সরিষার বৈশ্বিক চিত্র: মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) দেয়া পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই মৌসুমে বিশ্বব্যাপী সরিষা বীজের উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী সরিষা উৎপাদন হয়েছিল ৬ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৯৪ লাখ ৪০ হাজার টনে। সেখান থেকে গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টনে। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ কোটি ৪ লাখ টন সরিষা উৎপাদন হয়েছিল, যা পরের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) হ্রাস পেয়েছিল। এরপর টানা দুই অর্থবছর ধরে বৃদ্ধি পাওয়ার পর চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) তা আবার হ্রাস পাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ইউএসডিএ। আগের এক পূর্বাভাসে চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী মোট ৭ কোটি ২১ লাখ টন সরিষা উৎপাদনের কথা বলা হলেও গত মাসের সংশোধিত পূর্বাভাসে তা ৭ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টনে নামিয়ে এনেছে ইউএসডিএ।
ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বৈশ্বিক সরিষা বীজ উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে কানাডা। সম্মিলিতভাবে পরের অবস্থানটি দখল করে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ-২৭) দেশগুলো। তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীন। এছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত ও ইউক্রেন। বাংলাদেশের অবস্থান এদিক থেকে একাদশ।
বাংলাদেশে সরিষা: বাংলাদেশে মূলত তিন ধরনের সরিষা আবাদ করা হয়। এগুলো হলো টরি, শ্বেত ও রাই। এসব সরিষার যেসব জাত বিশেষভাবে প্রচলিত, সেগুলো হলো টরি-৭, সোনালী, কল্যাণীয়া, দৌলত, বারি সরিষা-৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, রাই-৫ ইত্যাদি। অঞ্চলভিত্তিক তারতম্য ও জমির অবস্থা অনুযায়ী, কিছু জাত মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক পর্যন্ত বপন করা যায়। আবার কিছু জাত বপন করতে হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণের মধ্যে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরিষা উৎপাদন প্রায় স্থিতিশীল রয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫২ টন সরিষাবীজ উৎপাদন হয়েছিল। সেখান থেকে পরের দুই অর্থবছরে সামান্য বেড়ে ২০১৬-১৭ মৌসুমে তা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৬০ টনে।