সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মহান আল্লাহর ভাষা... 

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৬:৩২ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার

অনেকে বলেন, মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার ভাষা হলো আরবী। এ কথা প্রমাণ করার জন্যে তারা যুক্তি দিয়ে বলেন যে, পবিত্র কোরআন যেহেতু আল্লাহর বাণী, এবং এটি যেহেতু আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে, সুতরাং মহান আল্লাহ তায়ালার ভাষাও আরবী।

একই যুক্তির ভিত্তিতে ইহুদীরা বলেন, আল্লাহ তায়ালার ভাষা হলো হিব্রু ভাষা। যেহেতু তাওরাত আল্লাহর বাণী, এবং তা হিব্রু ভাষায় নাযিল হয়েছে, সুতরাং আল্লাহ তায়ালার ভাষা হলো হিব্রু।

এ কারণে নাস্তিকরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে– ‘আচ্ছা, তোমাদের আল্লাহ কী আগে হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, আর এখন আরবী ভাষায় কথা বলেন?’

এর উত্তর খুবই সহজ।

আরবী ও হিব্রু ভাষাসহ পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা-ই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নিজের ভাষা তাঁর সৃষ্ট ভাষার মতো নয়। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন–

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

 

‘কোনো কিছুই আল্লাহর সাদৃশ্য নয়, তিনি শুনেন এবং দেখেন।’ (সূরা: শূরা, আয়াত:  ১১)

অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার ভাষা আমাদের পৃথিবীর মানুষের ভাষার মতো নয়। আমরা আরবী, বাংলা, উর্দু, ফার্সি, টার্কি, ইংরেজি বা হিব্রু, যে ভাষায় কথা বলি না কেন, সে ভাষা আল্লাহ তায়ালার নিজের ভাষা নয়।

কুরআন আল্লাহর বাণী হলেও আরবী ভাষা যে আল্লাহর ভাষা হতে পারে না, তা বুঝার জন্যে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে, কুরআন কি?

আমরা যে কোরআনকে হাতে ধরতে পারি, অথবা, যে কোরআনকে আমরা কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারি, সেটি হলো কোরআনের একটি প্রতিকৃতি, কিন্তু সেটি আসল কোরআন নয়।

কথাটা আরো অনেক সহজ করে ইমাম আবু হানিফা তার ‘ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থে বলেছেন। তিনি বলেন–

واالقرآن كَلَام الله تَعَالَى فِي الْمَصَاحِف مَكْتُوب وَفِي الْقُلُوب مَحْفُوظ وعَلى الألسن مقروء وعَلى النَّبِي عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام منزل ولفظنا بِالْقُرْآنِ مَخْلُوق وكتابتنا لَهُ مخلوقة وقراءتنا لَهُ مخلوقة وَالْقُرْآن غير مَخْلُوق

 

‘কোরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মাঝে সংরক্ষিত, জিহ্বাসমূহের দ্বারা পঠিত, এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর অবতীর্ণ। কোরআনের জন্যে উচ্চারিত শব্দগুলো সৃষ্ট, কোরআনের জন্যে আমাদের লিখিত বইটি সৃষ্ট, আমাদের তেলোয়াত সৃষ্ট, কিন্তু কোরআন সৃষ্ট নয়।’

অর্থাৎ, কোরআনের শব্দগুলো আমরা যখন আমাদের কণ্ঠে উচ্চারণ করি, কিংবা, কোরআনের অক্ষরগুলো যখন আমরা কাগজে লিখি, তখন সেটি মানুষের সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু, আল্লাহ বাণী হিসাবে যে কোরআনের কথা বলা হয়, তা কেউ সৃষ্টি করেনি।

যে কোনো ভাষার যেমন শুরু বা শেষ আছে, তেমনি আরবী বা হিব্রু ভাষারও শুরু বা শেষ আছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যেমন অনন্ত ও অসীম, তেমনি তাঁর ভাষাও অনন্ত ও অসীম। সুতরাং, পৃথিবীর কোনো ভাষাই কখনো আল্লাহ তায়ালার ভাষা হতে পারে না।

ইমাম আবু হানিফা বিষয়টিকে আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলেন–

ويتكلم لا ككلامنا ، ويسمع لا كسمعنا، ونحن نتكلم بالآلات والحروف، والله تعالى يتكلم بلا آلة ولا حروف ، والحروف مخلوقة وكلام الله تعالى غير مخلوق

‘আল্লাহ তায়ালা কথা বলেন, তবে তাঁর কথা আমাদের কথা বলার মতো নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের মতো নয়। আমরা বাগযন্ত্রের ও অক্ষরের সাহায্য কথা বলি, কিন্তু আল্লাহ বাগযন্ত্র ও অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলো সৃষ্ট, কিন্তু আল্লাহর কালাম বা কথা সৃষ্ট নয়।‘

 

অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার ভাষা আছে, কিন্তু সে ভাষা আমাদের মানুষদের কোনো ভাষার মতো নয়।

বাস্তব জগত থেকে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আশা করি।

ধরুন, আপনার প্রিয়জন অনেক ভাষা জানেন। ফেইসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে তিনি কখনো বাংলা ভাষায়, কখনো ইংরেজি ভাষায়, কখনো আরবী ভাষায়, কিংবা কখনো টার্কি বা ফার্সি ভাষায় আপনাকে ম্যাসেজ পাঠান। তিনি যে ভাষাতেই আপনাকে ম্যাসেজ পাঠান না কেনো, সঙ্গে সঙ্গে তা বাইনারি ভাষায় অর্থাৎ শূন্য ও একে (০, ১) রূপান্তরিত হয়ে যায়। 

বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, আরবী, ফার্সি ইত্যাদি ভাষা মোবাইল বুঝে না, সে কেবল একটি ভাষা বুঝে, যার নাম বাইনারি। আপনি আপনার প্রিয়জনকে কোনো ভিডিও, কোনো ছবি, অথবা, কোনো ম্যাসেজ যাই পাঠান না কেন, মোবাইল বা ল্যাপটপ তাকে পরিবর্তন করে তার নিজস্ব ভাষা বাইনারি করে ফেলবে।

যেমন ধরুন, আপনি যদি আপনার প্রিয়জনকে বলেন যে – ‘I love you’ তাহলে সেটি মোবাইলের ভাষায় হবে– 

‘01101001 00100000 01101100 01101111 01110110 01100101 00100000 01111001 01101111 01110101’

অর্থাৎ, মানুষের ভাষা ও যন্ত্রের ভাষা এক নয়। মানুষ যেভাবে কথা বলে যন্ত্র সেভাবে কথা বলতে পারে না। যন্ত্রের কাছে আরবী, উর্দু, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, টার্কি বা ফার্সি ভাষা বলে কোনো ভাষা নেই, সে শুধু বাইনারি ভাষায় কথা বলতে পারে।

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে। তিনি মানুষের মতো কোনো অক্ষর বা ভাষা ছাড়াই কথা বলেন। তাঁর কথা কেবল নবী ও রাসূলগণ বুঝতে পারেন। নবী ও রাসূলগণ আল্লাহর কথাকে তাঁদের নিজেদের ভাষায় রূপান্তরিত করেন। সুতরাং, আল্লাহ তায়ালার ভাষা আরবী, এ কথাটি মারাত্মক ভুল।

নাস্তিকরা যখন বলব, ‘আল্লাহ তায়ারা আগে হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, আর এখন আরবী ভাষায় কথা বলেন’ ‘তখন তাদেরকে বলতে হবে, আল্লাহ তায়ালা সকল ভাষা ও অক্ষর থেকে পবিত্র। 

আরবী বা হিব্রু কোনো ভাষায় আল্লাহ কথা বলেন না, আল্লাহ তাঁর নিজের মতো কথা বলেন, যা মানুষের মতো না।