ইসলামে উত্তম চরিত্রের অপরিহার্যতা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:৫১ এএম, ১ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার
মানুষের মেযাজ বুঝানোর জন্য আরবিতে ব্যবহার করা হয় আখলাক (اخلاق) শব্দটি। আখলাক (اخلاق) শব্দটি বহুবচন এর একবচন হলো খুলুকুন (خُلُقٌ)।
এই খুলুকুন শব্দটি খালকুন বা খালকান শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এর মূল অর্থ হলো সৃষ্টি করা, তৈরি করা, অস্তিত্ব দান করা, পুরাতন করা। কিন্তু এর থেকে নেয়া আখলাক শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। আখলাক দ্বারা জন্মগত বৈশিষ্ট্য বুঝায়, প্রাকৃতিক সুকমার বৃত্তি মেযাজ, সুন্দর মনোবাঞ্ছা, আদর্শবোধ, নৈতিকতা, স্বভাব চরিত্র, আদব বুঝায়।
বাংলায় চরিত্র স্বভাব বলতে যা বুঝায় আরবি আখলাক তেমনই কিছু বুঝায়। আখলাক বুঝানোর জন্য ইংরাজিতে যে শব্দটি অধিক ব্যবহার হয় তাহলো Character (ক্যারেক্টার)। ‘ওয়েবস্টার’ ডিকশনারির বর্ণনানুযায়ী একটি স্বভাব বা স্বভাবের উপাদানকে বুঝায়। তবে মানবীয় গুণাবলিরও অর্থ প্রদান করে, যেমন স্বভাব চরিত্র, চরিত্রের ধরণ, বোধ, ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, সুনাম সুখ্যাতি। আখলাক শব্দটিও এই সবই বুঝায়।
আখলাকের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অভিধানের বলা হয়েছে একটি চরিত্র মাধুর্যের জন্য যতগুণের প্রয়োজন সবগুলোই আখলাক (اخلاق) শব্দটি বুঝায়। সুন্দরভাবে কথা বলা, গালি না দেয়া, দান করা, দুঃখিত হওয়া, অন্যকে আনন্দ দেয়া, হিতৈষী হওয়া, সবর, সততা, স্পষ্টভাষী, শান্তভাব, লজ্জাশীলতা, বীরত্ব, বিনয়ী হওয়া, ধীরস্থিরতা, দৃঢ়তা, দৃঢ়চিত্ততা, ন্যায়বিচার, পরার্থরতা, হেকমত, সুধারণা, পোষণ, সহযোগিতা, সহনশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, সমবেদনাবোধ, রসিকতা, মহত্ত, ভদ্রতা, ভাবগাম্ভীর্য, মহানুভবতা, ওয়াদা পূরণ, উচ্চাকাক্সক্ষা, অল্পেতুষ্টি, কর্মোদ্যম, ইহসান, আমানত, জবানের হেফাযত, তাওবা গোপনীয়তা রক্ষা, ক্ষমাকরা ইত্যাদি।
‘অন্তর’ মানুষের ভেতরের একটি গোশত পিণ্ড। দেখা যায় না। আরবিতে বলা হয় কলবুন (قَلْبٌ)। মানুষের স্বভাবচরিত্র ওই কলব থেকে উদগত হয়। সুন্দর চরিত্র কিংবা দুষ্টযুক্ত চরিত্র সবই সেই অন্তর থেকে বের হয়। তাই চরিত্র সুন্দর হওয়ার জন্য অবশ্যক বস্তু হলো ভেতরের কলবের চরিত্র সুন্দর করা। বাহ্যিক চরিত্রের মেহনতের প্রয়োজন হয় না, কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র ভেতরটা সুন্দর করলেও অটোমেটিকলি বাহ্যিক চরিত্রও সুন্দর হয়ে যাবে। তাই বলে বাহ্যিক চরিত্র একেবারে অর্থহীন নয়। এই বাহ্যিক চরিত্রটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাহ্যিক চরিত্র ছাড়া অন্তরের চরিত্রতা প্রকাশ পায় না। ব্যবহারিক চরিত্র উন্নত হলেই ভেতরের চরিত্রের উন্নতি হয় না। তাই সুন্দর চরিত্র আদব আখলাক সৃষ্টি করার জন্য অন্তরের উপর কাজ করার প্রয়োজন। একজন মানুষ তখনই মানুষ বলে গন্য করা হবে যখন তার অন্তর মানুষ হবে। ইমাম গাযালি (রহ.) বলে অন্তর হলো ভেতরের এমন একটি ইঞ্জিন যার থেকে মানুষের কর্মধারা প্রকাশিত হয়। এর জন্য কোনো চাপাচাপি করতে হয় না। অন্তরের যখন ইচ্ছে প্রকাশ করে। প্রকাশের এই ধারায় যদি ভালো ও উপকারী কিছু প্রকাশ হয় তাকেই বলে উন্নত চরিত্র উত্তম আখলাক। আর প্রকাশের এই যদি পাপপঙ্কিলতা বা কলুষ রয় তাকেই বলে মন্দ বা দুশ্চরিত্র।
সুতরাং আত্মা থেকে উৎপন্ন চিন্তাকর্ম বা ভাববোধ যদি সুগন্ধি ছড়ায়, অন্ধকারকে আলোকিত করে, অসুন্দর করে সুন্দর করে, দূষিতকে দীপিত করে তবেই তা উত্তম আত্মা বা মনুষ্যচরিত্র। আর যদি আত্মা থেকে উৎপন্ন চিন্তাকর্ম বা ভাববোধ সংশ্লিষ্টব্যক্তি সমাজ দেশ ও দশকে নিকৃষ্ট করে তুলে তা-ই হলো মন্দচরিত্র বদআখলাক। এখন যদি কেউ এমন বলে যে, তার এই কাজটি ইচ্ছেকৃত হয়। এটা মানা যাবে না। কারণ অন্তর রেকর্ড করা বস্তুর ন্যায়। ভেতরে যাই থাকবে তাই বাজবে। কে বাজালো কীভাবে বাজালো তা কিন্তু রেকর্ড করা বস্তুটি চিন্তা করবে না। এমন হবে না যে, একজন ছোট ছেলে তার পিতা-মাতার অগোচরে গান বাজাচ্ছে হঠাৎ তার পিতা উপস্থিত! এখন কী রেকর্ড করা বস্তুটি চিন্তা করবে, আমি বাজবো কী বাজবো না? না সে চিন্তা করবে না। কারণ তাকে বানানোই হয়েছে এমন ভাবে যে, বোতাম টিপলেই বাজতে থাকবে। যেই টিপ দেয় যেসময়ই টিপ দেয়। আরেকটি উদাহরণ দিই, কারো আত্মার কামনা হলো দান করা। এখন সে যখন তখন মানুষকে দান করে বেড়ায়। নিজের থাকে কী না থাকে সে দিকে তার লক্ষ নেই। এই আত্মার ক্রিয়াকর্মই মানুষের আখলাককে ‘আখলাকে মামদুহা (সচ্চরিত্র) ও আখলাকে মাযমুমা (দুশ্চরিত্র)’ করে তুলে।
আখলাক (اخلاق) এর প্রকারভেদ:
কিছু কিছু আখলাক বা চরিত্র আছে যা মানুষের জন্মগতভাবেই ভেতরে থাকে। আর কিছু আখলাক আছে মানুষ অন্যকে দেখে, পড়ে, জেনে, বুঝে, সংস্পর্শে, চাপে পড়ে অর্জন করে। প্রথম প্রকার আখলাককে যদি আমরা নাম দিই তাহলে তার নাম হবে স্বভাবজাত আখলাক আর দ্বিতীয় প্রকারের নাম হবে কাসাবি বা অর্জিত আখলাক। একজন মানুষের জীবনচরিত্রে এই দুধরণের আখলাকই জরুরি ও অত্যবশ্যক। এই দুই আখলাকের ফলাফল অবশ্যই এক ও অভিন্ন। যদি সবগুলোই আখলাকই জন্মগত হয়, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ! আর যদি জন্মগত না থাকে একজন সুস্থ বিবেকমান মানুষের জন্য অবশ্যক হলো দ্রুত আখলাকে মামদুহাগুলা অর্জন করে নেয়া।
আখলাক প্রকাশের ক্ষেত্র চারটি-
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) প্রতি আচরণ:
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তার রাসূল (সা.)-কে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং রাসূল (সা.) এর আনীত বিধানাবলিকে মান্য করা। অনেকে আবার বলতে পারে এগুলো কী চরিত্র? হ্যাঁ, এগুলোই মূলত চরিত্র। সচ্চরিত্র থাকলেই তবে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও রাসূল (সা.)-কে বিশ্বাস করা যায়। অন্যথায় ঈমান আনার সুভাগ্য হয় না। দেখুন, নবীজি (সা.) এর প্রাথমিক দাওয়াতগুলোতে কারা ঈমান এনে মুসলমান হয়েছে? আর কারা ঈমান আনার সৌভাগ্য হয়নি।
নিজের সঙ্গে সদাচরণ:
নিজের সঙ্গে সদাচরণ করা অর্থ হলো নিজেকে কষ্ট না দেয়া। যেমন অসুস্থ হলে ওষুধ সেবন করা, পরিমিত খানা ও ঘুমানো, দৈহিক শ্রম দেয়া, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে চলাফেরা করা, বিপদে ধৈর্যধারণ করা ইত্যাদি।
অন্যের সঙ্গে আচরণ:
যেমন সত্য বলা, গালি না দেয়া, আমানত রক্ষা করা ইত্যাদি।
জীবজানোয়ারের সঙ্গে আচরণ:
জীবের সঙ্গে মানুষের জীবনে বহুঘনিষ্ঠতা আছে। সেখানেও প্রয়োজন হয় আচার আচরণের।
সবগুলো প্রকারগুলোতেই ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। এমন নয় শুধু ঈমান আনার ব্যাপারে বলেছে। ঈমান আনার যেমন আদেশ আছে তেমনি নিজেকে সবপাপ কর্ম থেকে বাঁচানোর আদেশও আছে। অন্য মানুষের সঙ্গে যেমন ভালো আচরণের হুকুম ইসলাম দিয়েছে তেমনি ভাষাহীন প্রাণের সঙ্গে যোগ্য আচরণের হুকুম ইসলাম দিয়েছে।
আখলাকে মামদুহা তথা সচ্চরিত্র’ এর প্রয়োজনীয়তা:
সচ্চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা কাগজে এঁকে সংজ্ঞা দিয়ে বুঝানোর বিষয় নয়। এর প্রয়োজন তেমনই যেমন মানুষের জন্য নিংশ্বাসের প্রয়োজন, পানির প্রয়োজন, প্রয়োজন আলোর। একটি দুশ্চরিত্র পুরো পৃথিবীকে বিষাক্ত করে দিতে পারে, দূষিত করতে পারে পাড়া মহল্লা, গাঁও, গেরামসহ পুরো একটি দেশ। আবার এর বিপরীতে একটি সুন্দর চরিত্র পুরো পৃথিবীকে শান্তির পথ দেখাতে পারে। দেখাতে পারে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ একটি সুখ সমৃদ্ধ মানবসমাজের। একজন মানুষের মনুষ্যত্বই মূল চরিত্র। এই মনুষ্যত্ব বিলীন হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পৃথিবী আর পৃথিবী থাকে না। এই মানুষ হয়ে ওঠে পশু আর পৃথিবীর হয়ে ওঠে একটি বিষাক্ত নরক। একারণেই রাসূল (সা.) এর সেই অমীয় বাণী إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاقআজো ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয় ইথারে ইথারে। অর্থাৎ উত্তম চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে। আরেকটি হাদিস শুনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عن القعقاع بن حكيم عن أبي صالح عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : إنما بعثت لأتمم صالح الأخلاق
অর্থাৎ হজরত কাকা ইবনে হাকিম আবি সাহেল থেকে আবু হুরায়রার সূত্রে বর্ণনা করেন; আমি কেবল সচ্চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।
এখানে গভীরভাবে উপলব্দির বিষয় যে, সচ্চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্যই আল্লাহ রাসূল (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। ঈমান আনার জন্যই নয় কিন্তু। তিনি কিন্তু বলেননি যে আমাকে নামাজ রোজা হজ জাকাত পূর্ণভাবে আদায় করার জন্য দুনিয়ায় প্রেরণ করেছে। কী বলেছেন? বলেছেন উত্তম চরিত্রের পূর্ণতার কথা। তাহলে কী ঈমান জরুরি নয়? বলবো উত্তম চরিত্রই হলো ঈমান। উত্তম চরিত্র ছাড়া কেউ ঈমান গ্রহণ করতে পারে না। ঈমান আর চরিত্র দুটি একটি মুদ্রার এপাশ ওপাশ মাত্র। যার ঈমান আছে তার চরিত্র আছে, যার চরিত্র আছে তার ঈমান আছে, যার ঈমান নেই তার চরিত্র নেই, যার চরিত্র নেই তার ঈমান নেই। এবার কয়েক শুনি। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –
عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا الزُّبَيْرِ يَقُولُ سَمِعْتُ جَابِرًا يَقُولُ سَمِعْتُ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.
অর্থাৎ হজরত জাবের (রাযি.) বলেন আমি রাসূল (সা.) থেকে শুনেছি তিনি বলেন- মুসলিম একমাত্র ওই ব্যক্তি যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ। এই হাদিসটি সিহাহ সাত্তার সবগুলো কিতাবেই বর্ণিত হয়েছে। বুখারি থেকে আরেকটি রেওয়াত পড়ছি,
عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه و سلم قال
: المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده والمهاجر من هجر ما نهى الله عنه
অর্থাৎ হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- মুসলিম একমাত্র ওই ব্যক্তি যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ। মুহাজির একমাত্র ওই ব্যক্তি যে, আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে বেঁচে থাকে। (বুখারি পৃষ্ঠা নং ১/১৩)
উপরোক্ত দুটি হাদিসে মুমিনকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে দুটি বিষয়ের সঙ্গে যে, যারা হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে তাকে মুসলিম বলে। এখানে একটি চরিত্রের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বদচরিত্র ব্যক্তি থেকে কেউ নিরাপদ থাকে না। সমাজ রাষ্ট্র পরের কথা। এমন কী তার আত্মীয় স্বজন। আরো ঘনিষ্ঠজন তার স্ত্রী ও স্বামী। মোটকথা তার হাত বা মুখ থেকে কেউ নিরাপদ থাকে। নিজেই নিরাপদ থাকে তার কাছে। অযথা বদআখলাকী প্রকাশ করে। যারা দ্বারা অন্যের ক্ষতি হয় না ঠিকই কিন্তু তার নিজের শরীরের আমলের অর্থের ক্ষতি হয়। ঈমান হলো সচ্চরিত্র, আর সচ্চরিত্র হলো ঈমান। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম ব্যক্তিকে এর একটি কোয়ালিটি বর্ণনা করেছেন। বুখারি হাদিস-
عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال : لم يكن النبي صلى الله عليه وسلم فاحشا ولا متفحشا وكان يقول (إن من خياركم أحسنكم أخلاقا)
অর্থাৎ হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল ছিলেন না, অশ্লীলতা পছন্দও করতেন না। তিনি বলতেন- তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র উত্তম, সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি। এমন স্পষ্ট কথার ব্যাখ্যা করা লাগে না।
উপরোক্ত আলোচনা হাদিস ও প্রাসঙ্গিক কথায় আমরা বুঝলাম ঈমানের অন্যনাম সচ্চরিত্র। আরা সচ্চরিত্রের অন্যনাম ঈমান। নামাজ রোজা আদায় করা ঈমানের কাজ। এই নামাজ রোজা কিন্তু অসচ্চরিত্র মানুষ করতে পারে না। যে ব্যক্তি নামাজ রোজা আদায় করলো সে দুশ্চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না। ঈমানের পরই নামাজের কথা বলা হয়েছে। কারণ কী? কারণ হলো এই ঈমান ঠিক রাখতে হলে নামাজের প্রয়োজন হয়। কেননা নামাজ চরিত্র নষ্ট হবার সকল উপাদান থেকে নামাজিকে রক্ষা করে। তাহলে এখানে নামাজও হলো সচ্চরিত্র সৃষ্টি ও সচ্চরিত্রকে ধরে রাখার একটি মাধ্যম।
মহান আল্লাহ সেই কথাই বলছেন,
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ
অর্থাৎ ‘হে নবী ওহির মাধ্যমে আপনার প্রতি যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে তা পাঠ করুন আর নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর যিকিরই সর্বপেক্ষা বড় জিনিস। তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা জানেন’ (সূরা আনকাবুত : আয়াত ৪৫)।
এই আয়াত দ্বারা বুঝলাম যে, নামাজ ঈমানের হেফাজতকারী। এখন একটি কথা বলি- যার ঈমান নেই সেকি নামাজ পড়লে কোনো কাজ হবে? হবে না। তাই বলা যায়, ঈমানের পর নামাজও ঈমানদারের চরিত্রকে পাপ মুক্ত রাখে। এবার আমরা একটি হাদিস শুনবো- যাতে বলা উত্তম আখলাকের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কী বলেন। বড়োই আশ্চর্যজনক কথা। যে হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় উত্তম আখলাকের মর্যাদা নামাজের মতোই।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
عن عائشة أن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن الرجل ليدرك بحسن الخلق درجة الصائم القائم
অর্থাৎ ‘একজন মানুষ সুন্দর চরিত্র মাধুর্য দ্বারা মর্যাদার যে উচ্চাসনে পৌঁছে যান, সে উচ্চাসনে নিয়মিত নফল আদায়কারী ও রোজাদারও তার নামাজ ও রোজার দ্বারা পৌঁছতে পারে।’ (মুসনাদ, ৪৭০, আদাবুল মুফরাদ ১০৭, মুজামুল কাবির ১৬৯)
মানুষ সচ্চরিত্র দ্বারা যে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারে শুধু নামাজ ও রোজা দ্বারাও সেই মর্যাদার আসনে পৌঁছতে পারে। কারণ কী? কারণ হলো সচ্চরিত্র হলোই নামাজ রোজা। দুটি ভিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। উপরোক্ত হাদিসের আলোকে একথাই প্রমাণিত হয়। দুনিয়ার সবাইকে সচ্চরিত্রবান হওয়ার নিমিত্তে রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন। প্রত্যেক মানুষ তখনই সফল হবে এবং জান্নাতের উপযুক্ত হবে যখন সচ্চরিত্রবান হয়। এই সচ্চরিত্রবান হওয়ার কথাটাই ভিন্ন সময় ভিন্নভাবে বলা হয়। যেমন আল্লাহর ওলি হও অর্থাৎ সচ্চরিত্রবান হও, নামাজি মুক্তাকি হও অর্থাৎ সচ্চরিত্রবান হও, সত্যবাদি হও অর্থাৎ সচ্চরিত্রবান হও, মিথ্যা বলিও না অর্থাৎ সচ্চরিত্রবান হও, অন্যের মাল খেয়ো না অর্থাৎ সচ্চরিত্রবান হও। ভালোর আদেশই সচ্চরিত্রের আদেশ যে ভাবেই যেশব্দে যে কৌশলেই দিক। একটি আয়াত উল্লেখ করে পরবর্তী আলোচনায় যাচ্ছি। আগে আয়াতটি তেলাওয়াত করি ও অর্থ শুনি।
মহান আল্লাহ বলেন-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
অর্থাৎ ‘বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ চরিত্র- এমন ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনকে বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে’ (সূরা আহযাব : ২১)
এই আয়াত থেকে কী বুঝলাম? আল্লাহ কী আমাদের লক্ষ করে এই কথা বলেছেন যে, তোমাদের জন্য রাসূল (সা.) এর জীবনীতে ঈমান রয়েছে? রাসূল (সা.) এর জীবনীতে নামাজ রয়েছে? রাসূল (সা.) এর জীবনীতে রোজা রয়েছে? না, এরকম কিছুই বলেনি। কী বলেছে? বলেছে- তোমাদের জন্য রাসূল (সা.) এর জীবনীতে উত্তম আখলাক আদর্শ চরিত্র রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলের জীবনকে রাসূল (সা.) এর চরিত্রের ন্যায় চরিত্রবান করে দিন। আল্লাহুম্মা আমিন।