ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে কুকুর পোষা অবৈধ নয়
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:৫৯ এএম, ১ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টিকে বিশেষ কাজের জন্য দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টিই প্রতিনিয়ত তাঁর ইবাদত করছে।
মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা করা হয়েছে এবং আল্লাহর সৃষ্টি বাকি সকল জীব-জন্তুকে এর পরে স্থান দেয়া হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্ট এমন একটি বিশেষ উপকারী এবং বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে কুকুর এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই তাই বলা যায়, কুকুরকেও বিশেষ কাজের জন্যই আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন (সেটা হতে পারে ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করা, চোর-ডাকাতকে ভয় দেখানো, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা- যেটা মোটামুটি বৈজ্ঞানিক দিক দিয়েও স্বীকৃত)। তাই আজকের আলোচনায় ইসলামের দৃষ্টিতে কুকুর সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে।
কুকুর হলো সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্থ এবং প্রভু ভক্ত প্রাণী। কিন্তু এই কুকুর পালন নিয়ে আমাদের ইসলাম ধর্মে অনেক মত বিরোধ রয়েছে। অনেকের মতে কুকুর পালন জায়েজ আবার অনেকের মতে কুকুর পালন জায়েজ নয়। যদিও কোরআনে কুকুর পালন নিয়ে তেমন কিছুই উল্লেখ নেই তবে বিভিন্ন হাদিসে এ সম্পর্কে অনেক বর্ণনা এসেছে।
কুকুর নাপাক বা হারাম কিনা:
প্রথমে এই ভুল ধারণা দূর করা উচিত যে কুকুর নাপাক বা হারাম। কুকুর নাপাক নয়, কিন্তু কুকুরের লালা নাপাক (মতান্তরে)। মতান্তরে বলার কারণ সামনে ব্যাখ্যা করা হবে। তার মানে দাড়াচ্ছে যদি আপনার সঙ্গে কুকুরের শরীরে স্পর্শ ঘটে তাহলে আপনি/আপনার কাপড় কোনোটাই নাপাক হবে না।এখন আমরা অনেকেই কুকুর যে নাপাক তার প্রমাণ হিসেবে যে হাদিস গুলোকে উল্লেখ করি তা হলো, মুসলিম শরীফে ২৭৯ ও ২৮০ নম্বর হাদিস- ‘যদি কোনো কুকুর তোমাদের কোনো পাত্রে মুখে দেয়, তাহলে সেটাকে সাত বার ধুতে হবে এবং একবার মাজতে হবে মাটি দিয়ে।’
২৭৯ নম্বর হাদীসে মাটি দিয়ে মাজার কথা বলা হয়েছে প্রথম বারেই এবং ২৮০ নম্বর হাদীসে মাটি দিয়ে মাজার কথা বলা হয়েছে ৮ম বারে অর্থ্যাৎ সাতবার পানি দিয়ে ধোয়ার পর। মাটি দিয়ে মাজার ব্যাপারটা যদিও দুইরকম কিন্তু প্রসঙ্গ হচ্ছে, দুই মাজহাব এখানে ব্যাপারটা দুইরকম করে উপস্থাপন করেছে।
(১) হানাফি মাজহাবের মতে- কুকুরের শরীর/পশম তাহির (পাক) কিন্তু তাদের লালা নাআ'জিস(নাপাক)।
(২) মালিকি মাজহাবের মতে- কুকুরের শরীর/পশম এবং লালা দুইটাই তাহির (পাক)। এবং এই মাজহাবের মতে সাতবার ধোওয়ার বিষয়টা এইখানে ঠিক নাপাক/অপবিত্রতা নয় বরং রোগ সংক্রমন বা রোগ-জীবানু ছড়াতে বাধা দানের একটা খুবই স্বাভাবিক ব্যবস্থা।
মাজমু'ও আল-ফতোয়া ২১/৫৩০ এ উল্লেখ রয়েছে- ‘কোনো কুকুরের লালা যদি কোনো মানুষ বা তার কাপড়কে স্পর্শ করে তাহলে সেটা অজু ভঙ্গ করে না’।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসলামা (র.) আদী ইবন হাতিম (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি নবী (সা:)-কে জিজ্ঞাসা করলাম। আমি আমার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর (শিকারের জন্য) ছেড়ে দেই। নবী (সা:) বললেন, যখন তুমি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে তোমার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরগুলো ছেড়ে দেবে এবং যদি সে কোনো শিকার ধরে আনে তাহলে তা খেতে পার। আর যদি ধারাল তীর নিক্ষেপ কর এবং এতে যদি শিকারের দেহ ফেড়ে দেয়, তবে তা খেতে পার।’ (সহীহ বুখারি অধ্যায়ঃ তাওহীদ প্রসঙ্গ হাদিস নাম্বর: ৬৮৯৩)
আবার, সূরা মায়েদার ৪ নম্বর আয়াতে আছে, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, কি বস্তু তাদের জন্যে হালাল ? বলে দিন- তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে। যেসব শিকারী জন্তুকে তোমরা প্রশিক্ষন দান করো শিকারের প্রতি প্রেরণের জন্যে এবং ওদেরকে ওই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষন দাও, যা আল্লাহ তোমাদেকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমন শিকারী জন্তু যে শিকারকে তোমাদের জন্যে ধরে রাখে, তা খাও এবং তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। আল্লাহকে ভয় করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ সত্বর হিসাব গ্রহণকারী।’
তাফসীরে দেখা যায় যে, তখন শিকারের জন্য শিকারী প্রাণী ব্যবহার করা বেশ প্রচলন ছিলো। এবং চারটা শর্ত মানলে কুকুর/বাজ ইত্যাদি দ্বারা শিকার করা জন্তু হালাল হবে।
(১) শিকারী শিক্ষাপ্রাপ্ত (ট্রেইনড) হতে হবে।
(২) আপনার ইচ্ছায় সে যাবে, আপনার ইচ্ছায় সে ফিরে আসবে। তার নিজের ইচ্ছায় শিকারের পিছনে ছুটতে পারবেনা।
(৩) শিকারী নিজে ওই শিকার করা জন্তু খাবে না, আপনার জন্য নিয়ে আসবে।
(৪) শিকারী কুকুর/বাজকে ছাড়ার আগে বিসমিল্লাহ বলতে হবে।
এই শর্তগুলা পূরণ হলে যদি শিকারী আপনার কাছে জন্তু আনতে আনতে সেটা মারাও যায় তাহলেও সেটা হালাল। আর বেঁচে থাকলে জবেহ করতে হবে।
যদি ইসলামে কুকুর হারাম বা নাপাকই হত তাহলে কোরআনে বা হাদিসে সরাসরি হারাম ঘোষণা করা হতো। এটাকে দিয়ে শিকার করে খাওয়া বা শস্যক্ষেত পাহারা দেয়ার কথা বলা হত না। তবে বিশেষ কিছু দিক বিবেচনা করে ও এর ক্ষতির দিক চিন্তা করে বিভিন্ন হাদিসে কুকুরকে বিনা কারণে পালন করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
‘শিকারের উদ্দেশ্যে, ফসল হেফাজতের উদ্দেশ্যে, পাহারাদারির জন্য, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির হেফাজতের লক্ষ্যে, ঘর-বাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারার জন্য, অপরাধের উৎস সন্ধান ও অপরাধীকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে কুকুর লালন-পালন করা বৈধ।’ (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া: খ.১৮, পৃ.২৬৪/ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: খ.৪, পৃ.২৪২)।
তবে শখ করে ঘরে কুকুর রাখা, মানুষের চেয়ে কুকুরের যত্ন বেশি নেয়া, কুকুরের সঙ্গে মানবীয় সম্পর্ক স্থাপন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিকার করা বা গবাদি পশু পাহারা অথবা শস্যক্ষেত পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া কুকুর লালন-পালন করে, প্রতিদিন ওই ব্যক্তির দুই কিরাত পরিমাণ নেকি হ্রাস পায়।’ (মুসলিম: হাদিস ১৫৭৫; তিরমিজি: হাদিস ১৪৮৭)
অন্য এক হাদিসে আছে, ‘এক কিরাত হলো, উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ।" (মুসনাদে আহমদ: হাদিস: ৪৬৫০)
অন্যত্র বলা হয়েছে যে, ঘরে কুকুর রেখে লালন-পালন করা ইসলাম কঠোর নিষেধ করেছে। কেননা, কেবল শখ করে ঘরে কুকুর রাখা ইসলামি শরিয়ত সম্মত নয়। আর এ জন্যই হাদিস শরীফে এসেছে, ‘যে ঘরে কুকুর আছে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না।’ (সহিহ বোখারি শরিফ: ৫৫২৫)।
আবদুল্লাহ ইবন ইউসুফ (র.) আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) কুকুর মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সহীহ বুখারি অধ্যায়: সৃষ্টির সূচনা হাদিস নাম্বার: ৩০৮৯)।
বুখারী শরীফে ৩:২৯:৫৫-তে আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসূল(সা.) বলেছেন, পাঁচ ধরণের জন্তু অনিষ্ট করে এবং এইগুলাকে অভয়ারণ্য/আশ্রয়স্থলে থাকলেও মেরে ফেলা যাবে। এইগুলা হচ্ছে- ইদুর, বিচ্ছু/বিছা, চিল, কাক এবং পাগল (র্যাবিড) কুকুর।’
এই একই হাদিস আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়ে বুখারীসহ আরো কিছু হাদীস শরীফে কয়েকটা জায়গায় উল্লেখ পেয়েছে। জায়গাগুলো হচ্ছে- মুসলিম ৭:২৭১৮, মুসলিম ৭:২৭১৯, বুখারী ৪:৫৪:৫৩১।
রাসূল (সা.) আরেক স্ত্রী হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত বুখারীর ৩:২৯:৫৪, মুসলিম ৭:২৭২৫-তে একই হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
এর থেকে বোঝা যায় যে, কুকুর হত্যা করার হাদিসটিতে সব কুকুরকে হত্যার কথা বলা হয়নি।
ইয়াহইয়া ইবন সুলাইমান (র.) সালিম (রা.) তার পিতার নিকট হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী (সা.)-কে (সাক্ষাতে) ওয়াদা দিয়েছিলেন। (কিন্তু তিনি সময় মতো আসেন নি। নবী (সা.) এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন, আমরা ওই ঘরে প্রবেশ করি না, যে ঘরে ছবি এবং কুকুর থাকে।’ (সহীহ বুখারি অধ্যায়: সৃষ্টির সূচনা হাদিস নাম্বর: ৩০০০)।
বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষ কুকুরের গোশতকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে যা ইসলামে পরিপূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়া কুকুর ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ (র.) আবূ মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, ‘নবী (সা.) কুকুরের মূল্য যিনাকারিনীর মজুরী ও গণকের পারিশ্রমিক দিতে নিষেধ করেছেন।’ (সহীহ বুখারি অধ্যায়: চিকিৎসা হাদিস নাম্বরঃ: ৫৩৪৯)
এ প্রাণীটি নিয়ে ইসলামে একাধিক হাদিস বর্ণিত আছে। যা অধিকাংশ হাদীসেই কুকুর পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু উদ্দেশ্যে কুকুর পালনে বৈধতা দেয় ইসলাম, আর তা হলো:
১. শিকারের উদ্দেশ্যে,
২. ফসল হেফাজতের উদ্দেশ্যে,
৩. পাহারাদারির জন্য,
৪. ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির হেফাজতের লক্ষ্যে,
৫. ঘরবাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারার জন্য,
৬. অপরাধের উৎস সন্ধান ও অপরাধীকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে কুকুর লালন-পালন করা বৈধ।
বলা বাহুল্য, শিকার এবং পাহারার জন্য অথবা অপরাধী শনাক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় কুকুর পোষা বৈধ। (ইবনে উসাইমিন)।
তবে কুকুর থেকে বিভিন্ন হাদিসের মাধ্যমে বিরত থাকতে বললেও তাকে কষ্ট দেয়ার কথা বলা হইনি বরং কুকুরের সেবা করার মাধ্যমে জান্নাত লাভের ঘটনা হাদিসে বর্ণিত আছে, সম্ভব হলে কুকুরকে খাবার দেয়া, পানি দেয়া, কুকুর কোথাও পড়ে গেলে তাকে উদ্ধার করা ইসলামের দৃষ্টিতে সওয়াবের কাজ। বিশুদ্ধ হাদিসে কুকুরকে পানি খাওয়ানোর কারণে ব্যভিচারীনি নারীকেও জান্নাত দান করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একবার এক পিপাসা কাতর কুকুর কূপের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। পিপাসায় তার প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারীনী নারী তা দেখতে পায়। সে নিজের পায়ের মোজা খুলে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এ কারণে তার অতীত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৪৬৭)
পরিশেষে বলা যায় যে, বিনা কারণে বিলাসিতার জন্য কুকুর পালন করা, মাত্রাতিরিক্ত সেবা-যত্ন যা মানুষের জন্যেও করা হইনা, অপচয়, ক্ষতির উদ্দেশ্যে ইত্যাদি কারণে ইসলামে কুকুর পালন নিষেধ তবে উপরিউক্ত আলোচ্য সৎ উদ্দেশ্যেগুলো থাকলে কুকুর পালনে ইসলামে কোনো নিষেধ নেই।