সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নারীদের আদব কর্তব্য ও মর্যাদাসমূহ

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ১১:০৮ এএম, ১ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

ঘর বা আবাসগৃহ হচ্ছে এমন একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার এই মৌলিক উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে: স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা এবং সন্তান-সন্তুতি। 

 

সুতরাং তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম; তিনি বলেন, ‘আর আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল।’ (সূরা আন-নাহল: ৮০)

আর এই ঘরের গুরুত্ব ও তার মহান মর্যাদার কারণে ইসলাম তার বিষয় ও কার্যক্রমসমূহকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহকে তার মৌলিক উপাদান অনুযায়ী বণ্টন করেছে; বিশেষ করে মৌলিকভাবে মুসলিম নারীর সঙ্গে যা সংশ্লিষ্ট (তা), কেননা সে হচ্ছে ঘরের মধ্যে মা, অনুরূপভাবে স্ত্রী, কন্যা ও বোন; সুতরাং ঘরের মধ্যে তার অনেক বড় করণীয় রয়েছে এবং ওই ঘর নামক রাষ্ট্রের মধ্যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যও অনেক বড়, যে রাষ্ট্রের অবকাঠামোকে ধ্বংস করার জন্য ইসলামের শত্রুগণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, এ রাষ্ট্রটি হচ্ছে সমাজের অতি প্রসারিত এক বৃহৎ গবাক্ষ। সুতরাং যখন তাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

 

নারীকে সমাজের অর্ধেক বলা হয়ে থাকে; আর নারী তিনি তো মাতা, স্ত্রী, কন্যা, বোন, নিকটাত্মীয়া ...; আর তিনি তো লালন-পালনকারিনী, শিক্ষিকা, শিশুদের পরিচর্যাকারিনী। আর তিনি হলেন পুরুষদের জন্মদাত্রী, বীরপুরুষদের লালন-পালনকারিনী, মহিলাদের শিক্ষিকা। আবার তিনি হলেন নেতা, আলেম ও দা‘ঈ তথা আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের গড়ে তোলার অন্যতমা কারিগর।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ারা তাকে হজরত আদম (আ.) থেকে সৃষ্টি করেছেন; তিনি বলেন,
 • ‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন; আর যিনি তাদের দুইজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন; আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট নিজ নিজ হক দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। ( সূরা আন-নিসা: ১)।

আর সেখান থেকেই ইসলামী চিন্তাবিদগণ নারীদের ব্যাপারটি নিশ্চিতভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন, যেভাবে আল-কোরআনুল কারীম সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে; একজন মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা হিসেবে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানসমূহ; সঙ্গে সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে তার অধিকার এবং আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ।

 

প্রথম ক্ষেত্র: তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য-

(১) ঈমানী দায়িত্ব:
প্রথমেই তার দায়িত্ব হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং ইসলামের হুকুম-আহকামগুলো পূর্ণভাবে মেনে চলা। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমজানে সাওম পালন, জাকাত ফরজ হলে তা নিয়মিত আদায় করা তার নিজের প্রতি প্রথম দায়িত্ব।

(২) পূর্ণ হিজাব পালন করা: 
নারীদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে তারা গায়ের মাহরাম পুরুষ ও অমুসলিম নারীদের সামনে পূর্ণ হিজাব পালন করবে ।

আল্লাহ ঈমানদার নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা নূর: ৩১ )

 

‘হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ ( সূরা আহযাব : ৫৯)

কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ পোশাক পড়ার নিয়ম আছে ছেলে ও মেয়েদের জন্য প্রধানত নিয়ম ৬টি।
এ নিয়মগুলোকে হিজাব বা পর্দা বলা হয় । এ নিয়মগুলো হলো-

(ক) মেয়েদের মুখ ও হাতের কব্জি ছাড়া সমস্ত দেহ ঢাকতে হবে । ছেলেদের ন্যূনতম পক্ষে নাভির উপর হতে হাটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা।
(খ) এমনভাবে পোশাক পরিধান করবে তা কোনো প্রকার আটসাট হবে না যাতে শরীরের গড়ন বুঝা না যায় । ঢিলেঢালা পোশাক পড়তে হবে।
(গ) পোশাক পরিচ্ছদ স্বচ্ছ হবে না, যাতে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখা যায় ।
(ঘ) পোশাক পরিচ্ছদ আকর্ষনীয় হবে না যা বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষন করে ।
(ঙ) পোশাক পরিচ্ছদ এমন হবে না, যা অমুসলিমদের মত। যেমন: খ্রিস্টানদের ক্রস পড়া যাবে না ।
(চ) এমন পোশাক পরিধান করা যাবে না, যা বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের মত।

(৩) জ্ঞান অর্জন করা: 
মুসলিম নারীকে ইসলাম যে সম্মান দান করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো: ইসলাম নারীর জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা ও শিক্ষা প্রদান করার মর্যাদা পুরুষের মর্যাদার মত করে সমানভাবে নির্ধারণ করেছে এবং নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের জন্য কোনো বিশেষ মর্যাদা নির্দিষ্ট করেনি। শিক্ষা এবং শিক্ষা গ্রহণের ফজিলত বা মর্যাদা বর্ণনায় বর্ণিত সকল আয়াত ও হাদিস পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে মর্যাদাবান বলে অবহিত করে; যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন।’ (সূরা আল-মুজাদালা: ১১)

‘বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কী সমান?’ ( সূরা আয-যুমার: ৯ )

 

আল্লাহ তায়ারা নারীদের যে কঠিন দায়িত্বটি দিয়েছেন, সেটি হলো ঘর ঠিকভাবে সামলে সন্তানদের যোগ্য, ঈমানদার মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলা, তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন হলো জ্ঞানার্জন করা।

(৪) সৎকর্ম করা:
ঈমান ও ইলম (জ্ঞান) অর্জন যেমন একজন মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, তেমনি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, সে এই জ্ঞানের দাবি অনুযায়ী আমল বা কাজ করবে; আর এই আমল ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতে তার কোনো ফলাফল অর্জিত হবে না। আর সেই হলো মুসলিম বুদ্ধিমতী নারী, যে তার জন্য এই সালাত, সাওম, দান-সাদকা, হজ, ওমরা, দাওয়াত, সৎকাজের আদেশ করা, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা, সততা, পরোপকার ইত্যাদি নফল ইবাদতের কিছু অংশ বরাদ্ধ করে রাখে।

অনুরূপভাবে আদব-কায়দা, শিষ্টাচারিতা ও নৈতিক চরিত্র, যা আত্মস্থ করা মুসলিম নারীর জন্য আবশ্যক; যেমন: কথায় ও কাজে সত্যবাদিতা, মিথ্যা না বলা, ধৈর্যধারণ করা, অপরের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা, কথার সময় বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করা, সাক্ষাতের সময় প্রফুল্ল থাকা এবং চলাফেরায়, পানাহারে, ঘুমানোর সময়, কথাবার্তায়, উঠা-বসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রাখা। সুতরাং মুসলিম নারীর উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো এইসব মর্যদাপূর্ণ নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে আত্মনিবেদন করা এবং এসব উত্তম আচরণ ও শিষ্টাচারের অনুসরণ করা।

(৫) অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা:
একজন মুসলিম নারীর নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের অধীনে আরো যা অন্তর্ভুক্ত হয়, তা হলো তার নিজেকে অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা করা; শয়তানের পথসমূহ বন্ধ করা এবং কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। 

আত্মার দুর্বলতা ও আল্লাহ তায়ালার প্রতি আস্থাহীনতা থেকে সতর্ক থাকা; আরো সতর্ক থাকা জাদুকর, ভেলকিবাজ, ভণ্ড ও প্রতারক, জ্যোতিষী, ভবিষ্যতবাণী পাঠকারী প্রমুখের মত কাফির, ফাসিক ও পথভ্রষ্টদের থেকে।

মুসলিম নারীদের মান-সম্মানের মধ্যে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা থেকে সতর্ক থাকা, যা অধিকাংশ নারীর মধ্যে ছড়িয়ে আছে; কারণ, গীবত (পরচর্চা) করা, কুৎসা রটনা করা, মিথ্যা কথা বলা এবং অমুক পুরুষ ও অমুক নারীর সমালোচনা করাটা তাদের মজলিস বা বৈঠকসমূহের প্রাণে পরিণত হয়।।

 

বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন সর্বক্ষেত্রে কাফির নারীদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা থেকে সতর্ক থাকা; আর সতর্ক থাকা তাদের (কাফির নারীদের) কর্মকাণ্ডে বিমুগ্ধ হওয়া থেকে। কারণ, মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ নারী চুল, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির আকৃতি ও ধরন-প্রকৃতির ক্ষেত্রে প্রত্যেক (বহিরাগত ও শরী‘আত গর্হিত) হৈচৈ সৃষ্টিকারী নারী-পুরুষের অনুসরণ করতে শুরু করে দিয়েছে।