সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর পছন্দের পোশাক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ১১:১০ এএম, ১ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

পোশাক পরিচ্ছদ মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য বিষয়। আল কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, পৃথিবীর আদি মানুষ হজরত আদম (আ.) পোশাক পরিধান করতেন।

 

যেমন সূরা আরাফের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে কাপড় খুলে পড়ে যায়। সর্বকালেই সভ্য মানুষেরা লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার জন্য পোশাক পরিধান করতো। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও এমন পাওয়া যায়নি, যারা স্বভাবজাত এই বিধানের বাইরে চলেছে আর পৃথিবীবাসী তাদেরকে সভ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যাদের অবস্থান মানব সমাজ থেকে বহু দূরে, জংলি জানোয়ারের ন্যায় জীবন যাপন করে তাদের কথা ভিন্ন। কারণ, তারা সমাজ, সভ্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

অতিতের প্রত্যেক সভ্য সমাজে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের পোশাকের গুরুত্ব বেশি ছিলো। কিন্তু বর্তমান অবস্থা হচ্ছে এর সম্পূর্ণ উল্টো। পোশাকের ক্ষেত্রে পুরুষরা শালীনতা রক্ষা করে চললেও নারীরা এ ব্যাপারে বেপরোয়া। ফলে ইভটিজিং ও ধর্ষণের মতো গুরুতর সামাজিক ব্যধিগুলো সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারন করছে। উপমহাদেশে ভারতে ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নগ্ন পোশাক।

 

আল কোরআনে পোশাকের আলোচনা: 
আল কোরআনে পোশাক সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং সাজ-সজ্জার বস্তু। আর পরহেযগারীর পোশাকই সর্বোত্তম পোশাক। এই পোশাক আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি, যাতে তারা গভীরভাবে চিন্তা করে।’ (সূরা আরাফ-২৬) 

আয়াতে পোশাক অবতীর্ণ করার অর্থ হচ্ছে, তার উপাদানগুলো সৃষ্টি করা এবং তা থেকে পোশাক তৈরির কলা-কৌশল শিক্ষা দেয়া। অর্থাৎ এগুলো আল্লাহ তায়ালা নিজ কুদরতে মানুষদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। অন্যথায় মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো না বস্ত্র ও তাঁত শিল্প আবিষ্কার করে এমন সুন্দর করে পোশাক তৈরি করা। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা পোশাককে তাঁর নেয়ামত ও কুদরতের নিদর্শন সাব্যস্ত করেছেন। উল্লেখিত আয়াতে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পোশাকের আলোচনা শুধু মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে করা হয়নি; করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতিকে উদ্দেশ্যে করে। বলা হয়নি হে মুসলমানেরা! বরং বলা হয়েছে ‘হে আদম সন্তানেরা! যার মাঝে মুসলিম ও অমুসলিম সকলে অন্তর্ভূক্ত। এর দ্বারা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, পোশাক পরিচ্ছদ এটা শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং সমস্ত আদম সন্তানের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে এই দিকেও ইশারা করা হয়েছে যে, পোশাক শুধু লজ্জাস্থান ঢাকার বস্তু নয় বরং সৌন্দর্য বৃদ্ধিরও কারণ। আর পোশাক দ্বারা ব্যক্তির সৌন্দর্য ফুটে ওঠবে যখন পোশাক শালীন হবে। আল কোরআনের আরো কয়েক জায়গায় পোশাকের আলোচনা এসেছে। যেমন সূরা আরাফ আয়াত নম্বর ৩১ ও ৩২।

 

আল্লাহ তায়ালার পছন্দের পোশাক:
নবী-রাসূলগণ (আ.) কখনো পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হতেন না। ঘুমানো, ঘুম থেকে ওঠা, পানাহার, প্রস্রাব-পায়খানা ইত্যাদির মতো সামান্য সামান্য বিষয় থেকে নিয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে তারা আল্লাহর তায়ালার নির্দেশনার আলোকে আঞ্জাম দিতেন। অনুসারীরাও যেন আল্লাহর মর্জি মাফিক সেগুলো করে, সে ব্যাপারেও তারা সদা সচেষ্ট থাকতেন। নবী করীম (সা.) যখন সাহাবাদেরকে এগুলোর তালিম দিতেন তখন কাফেররা হাসাহাসি করে বলতো,  ‘যে ব্যক্তি প্রস্রাব -পায়খানার তালিম দেয়, সে আবার নবী হয় কেমন করে!’ কিন্তু ওরা বুঝতে পারেনি যে দীন ইসলাম একটি ব্যাপক ধর্ম, যা জিন্দেগীর কোনো শাখা-প্রশাখাকে বাদ দেয়নি। প্রস্রাব-পায়খানার মতো হীন বিষয়গুলো যদি দীনের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে তাহলে পোশাক পরিচ্ছদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দীন থেকে বাদ যাবে কোনো যুক্তিতে? এমন তো হতে পারে না যে, রাসূল (সা.) সবকিছু করতে বলেছেন ওহির ভিত্তিতে আর পোশাকের কথা বলেছেন পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। বরং এক্ষেত্রেও তিনি আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন এটাই স্বাভাবিক।

আল্লাহর নির্দেশে বলেছেন বলেই কোনো পোশাকের ব্যাপারে তিনি বলেছেন এটা জায়েজ, কোনোটার ব্যাপারে বলেছেন নাজায়েজ, কোনটা উত্তম বা অনুত্তম ইত্যাদি। মুসলিম শরীফের এক হাদীস এসেছে নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘এটা কাফেরদের পোশাক তাই তা পরিধান করো না।’ (মুসলিম-৫৫৫৫) এই আলোচনার আলোকে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়, রাসূল (সা.) ওই পোশাক পরিধান করেছেন বা করতে বলেছেন যার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার হুকুম হয়েছে। এ ছাড়া সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি কোনো পোশাক পরেছেন এটা বলা ভুল। তাই রাসূল (সা.) এর পোশাক আল্লাহর পছন্দনীয় পোশাক। অতএব যারা বলেন, ‘কোনো পোশাকই ইসলামী নয় বরং সমাজের প্রচলিত পোশাকই ইসলামী পোশাক, রাসূল (সা.) যদি ইউরোপ বা আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে তিনি ওই সমাজের পোশাককেই শরয়ী পোশাক হিসেবে গ্রহণ করতেন’ এই কথার কোনো ভিত্তি নেই।

 

রাসূল (সা.) এর পোশাকের বর্ণনা:
রাসূল (সা.) দুনিয়া বিমুখ জীবন যাপন করেছেন। তাই তাঁর লেবাস ছিলো অত্যন্ত সাদাসিদা। লুঙ্গি, চাদর, কুর্তা, জুব্বা ও কম্বল এগুলো ছিলো রাসূল (সা.) এর পোশাকের অন্তর্ভূক্ত। তাঁর জামাকাপড় থাকতো তালিযুক্ত। সবুজ রং ছিলো তাঁর পছন্দের শীর্ষে। তবে তিনি সাদা কাপড়ই বেশি ব্যবহার করেছেন। সবুজ ও লাল সুতার কাজ করা ইয়ামানের একটি চাদর রাসূল (সা.) এর অনেক পছন্দ ছিলো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ওই চাদরটি ব্যবহার করতেন। শুধু লাল রং ব্যবহার করতে রাসূল (সা.) নিষেধ করতেন।

পোশাকের আলোচনায় রাসূল (সা.) এর টুপির বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, তাঁর টুপি ছিলো চ্যাপটা, যা মাথার সঙ্গে লেগে থাকতো। রাসূল (সা.) পাগড়ী ব্যবহার করতেন এবং পাগড়ীর নিচে টুপি থাকতো। তিনি লুঙ্গি পড়তেন টাকনু ও হাটুর মাঝ বরাবর। মক্কার মিনা বাজারে পাজামা দেখে নবী করীম (সা.) এর খুব পছন্দ হলো এবং বলেন, লুঙ্গির তুলনায় পাজামা দ্বারা সতরের বেশি হেফাজত হয়। তিনি পাজামা ক্রয় করেছেন বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা প্রমাণীত। তবে তিনি কখনো পাজামা পরিধান করেছেন বলে প্রমাণীত নয়। (ফতোয়ায়ে দারুল উলুম, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫৫)

পোশাক পরিচ্ছদের আদব: 
(এক) নতুন পোশাক পরিধানের সময় আল্লাহ তায়ালার হামদ বর্ণনা করা (দোয়া পড়া)। হজরত ওমর (রা.) বলেন, নতুন পোশাক পরিধানের সময় এই দোয়া পড়া চাই-

الحمد لله الذى كسانى ما أوارى به عورتى و اتجمل به فى حياتى

অর্থ : আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া, যিনি আমাকে এমন পোশাক পরিয়েছেন যা দ্বারা আমার শরীর আবৃত হবে এবং সাজ-সজ্জাও হবে।

(দুই) নতুন পোশাক পরিধানের সময় পুরাতন পোশাক গরীব-মিসকিনকে সদকা করে দেয়া। রাসূল (সা.) বলেন, নতুন পোশাক পরার সময় পুরাতন পোশাক সদকা করে দিলে সে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর জিম্মাদারীতে থাকবে। (মুসনাদে আহমদ, সূত্র মারেফুল কুরআন-৩/৫৩৫)

(তিন) অহংকার ফুটে ওঠে এমন পোশাক পরিধান না করা। রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের মন যা চায় খাও, পর। তবে দুটি জিনিস যেন না আসে-অহংকার ও অপচয়।  (বোখারী,২/৮২০)

 

(চার) বিলাসিতা ও অপচয় থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। (সূরা: বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৭)

(পাঁচ) অমুসলিমদের পোশাক থেকে দূরে থাকা। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদেরই দলভূক্ত হবে। (মুসনাদে আহমদ, ২/৫০)

(ছয়) লুঙ্গি, পাজামা ইত্যাদি টাকনু ও হাটুর মাঝ বরাবর থাকা; অন্ততপক্ষে টাকনুর উপরে থাকা। বহু হাদীসে এসেছে টাকনুর নিচের যে অংশ লুঙ্গি দ্বারা ঢাকা থাকবে তা জাহান্নামে যাবে। (বোখারী-৫৪৫০)

(সাত) পুরুষের জন্য রেশমি কাপড় ব্যবহার না করা। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে রেশমি কাপড় পরবে, আখেরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না। ( বোখারী-৫৪৯২)

(আট) একেবারে লাল ও হলুদ পোশাক পরা পুরুষের জন্য অনুচিত ও মাকরূহ। (ফতোয়ায়ে দারুল উলুম, খন্ড-১২,পৃষ্ঠা-১২৭)

(নয়) পুরুষেরা মহিলাদের ও মহিলারা পুরুষের লেবাস পরবে না। কারণ, যে ব্যক্তি এ কাজ করবে সে রাসূল (সা.) এর বদদোয়ার মধ্যে পড়বে। হাদীসে নবী করীম (সা.) এ ব্যক্তিদেরকে লানত করেছেন।

(দশ) টাইট পোশাক না পরা; যা শরীরে আঁটোসাঁটো হয়ে লেগে থাকে। বিশেষভাবে মহিলারা এ রকম পোশাক থেকে দূরে থাকা চাই। কারণ হাদীসে এসেছে, জাহান্নামীদের মাঝে ওই মহিলারাও থাকবে যারা পোশাক পরা সত্তেও উলঙ্গ। অর্থাৎ পোশাক এত টাইট থাকে যে, তা পরা সত্তেও শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ বুঝা যায়।

(এগার) নারীদের ক্ষেত্রে এমন মিহি পাতলা কাপড় না পরা, যার বাহির থেকে সবকিছু দেখা যায়। পুরুষের লুঙ্গি, পাজামা এরকম হলে তা পরা জায়েজ হবে না। তবে অন্য পোশাক হলে সমস্যা নেই।

(বার) পুরুষ ও মহিলা প্রত্যেকের এমন পোশাক পরা যাতে তাদের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। 

মাসায়ালা মাসায়েল:
(এক) পুরুষের নাভী থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত সতর (যা ঢেকে রাখা ফরজ)। নামাজে এর কোনো অংশ প্রকাশ পেলে নামাজ ফাসেদ হয়ে যেতে পারে। 

 

(দুই) মহিলাদের পুরো শরীর সতরের অন্তর্ভূক্ত। তবে চেহারা, দুই হাত ও পাঁ সতরের অন্তর্ভূক্ত নয়। অর্থাৎ নামাজে এগুলো প্রকাশ পেলে নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না। এবং কোনো গোনাও হবে না। কিন্তু এ কথার উদ্দেশ্য এই নয় যে, মহিলারা এগুলো বের করে অপরিচিত লোকের সামনে নির্দ্বিধায় যাতায়াত করতে পারবে। শরীয়ত এ রকম কোনো অনুমতি দেয়নি।

(চার) যে কাপড় পরে লোকদের সামনে যাওয়া লজ্জাজনক মনে হয় সেই কাপড় পরে নামাজ পরা মাকরূহ।

(পাঁচ) নামাজের সময় শুধু সতর ঢাকার কথা বলা হয়নি বরং সাজ-সজ্জার কথা বলা হয়েছে। অতএব, শুধু কাধে জামা ঝুলিয়ে বা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে নামাজ পড়া মাকরূহ।