হাঁটুর বয়সী নায়কদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ছেন যে নায়ক
নিউজ ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৩২ পিএম, ১৩ মার্চ ২০১৯ বুধবার
ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যিনি নিজেকে শীর্ষে ধরে রেখেছেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি রমরমা মসলাদার সিনেমা যেমন করেছেন, এখনো তেমনি ভিন্নধারার সিনেমার প্রয়োজনে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারি’র গানে যিনি শ্রোতাদের মাতোয়ারা করে তুলেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগের সিনেমা ‘অমরসঙ্গী’ সিনেমার যিনি রোমান্টিক নায়ক হয়ে এসেছিলেন, সে থেকে আজো ‘আমার দুঃখগুলো কাগজের মত’ গানে দর্শকদের মুগ্ধ করে চলেছেন।
এক কথায় তাকে যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রের আকার ধারণ করেন তিনি। তাই, আজো তিনি পাল্লা দিয়ে লড়ছেন হাঁটুর বয়সী নায়কদের সঙ্গে। তিনি সবার প্রিয় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আশির দশকের শেষভাগে যার আগমন ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রে।
এখনো তার সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শকরা উচ্চাশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তিনি নিজেকে পর্দায় উপস্থাপন করেন। মনের মানুষের লোক কবি সাঁইজি লালন যেমন হন, তেমনি তিনি ‘জাতিস্মর’-এর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিও। নিজের ‘দৃষ্টিকোণ’ বদল করে অটোগ্রাফের নায়ক অরুণ চ্যাটার্জী হয়েছেন। ছোটদের প্রিয় কাকাবাবু আর কয়েকদিন পরেই নিজেকে ভেঙে আসছেন কিশোর কুমারের ভক্ত হয়ে।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বাবা স্বনামখ্যাত অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে এই নায়কের প্রথম অভিনয়। উত্তম কুমারের আলোচিত সিনেমা ‘দুই পৃথিবী’-তেও শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। বাবা নায়ক হওয়া স্বত্তেও ছোটবেলা স্বাচ্ছন্দ্যে কাটেনি প্রসেনজিৎ-এর। মায়ের সাথে বিচ্ছেদ হবার পর বাবা সেইরকম খোঁজ খবর রাখতেন না তার। মা অনেক কষ্টে বড় কররেছিলেন প্রসেনজিৎ ও তার বোন পল্লবীকে।
আশির দশকে নায়ক চরিত্রে প্রথম অভিনয় ‘দুটি পাতা’ সিনেমায়। তবে আলোচনায় আসেন সাড়া জাগানো সিনেমা ‘অমর সঙ্গী’ সিনেমা দিয়ে। একক নায়ক হিসেবে সেই যাত্রা পূর্ণতা পায় তার ঠিক পরের বছর ‘অমর প্রেম’ সিনেমা দিয়ে। তপন সিনহার ‘আতঙ্ক’ থেকে ‘ছোট বউ’, ‘আশা ভালোবাসা’, ‘আপন আমার আপন’ সবগুলোই ছিল তার অভিনীত আশির দশকের সিনেমা।
‘একটা চিঠি দিলাম লিখে, মনের কথা আজ তোমাকে’ – নব্বই দশকের শুরুতেই পেলেন ‘মন মানে না’র মত সুপারহিট ছবি। আর সেই রেশেই এল ‘বিয়ের ফুল’ এর মত সাড়া জাগানো গান সমৃদ্ধ সিনেমা। একটা পর্যায়ে তিনিই হয়ে উঠেন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির একচ্ছত্র নায়ক। একের পর এক সিনেমা করতে থাকেন, রেকর্ড সংখ্যক সিনেমা মুক্তি পেতে থাকে তার।
এক সময় ভঙ্গুর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বাণিজ্যিক সিনেমার অবনমন হতে থাকে, অভিনয়ে স্থুলতা দেখা দেয়। এর মাঝেও অনেক বাণিজ্যিক সফল সিনেমা উপহার দেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। এর মধ্যে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘তুমি এলে তাই’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘বাবা কেন চাকর’ অন্যতম।
তৎকালীন সময়ে তার প্রতি সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল তিনি দাঁত চেপে অভিনয় করতেন। প্রভাত রায়, হরনাথ চক্রবর্তীদের সিনেমায় চলনসই হলেও স্বপন সাহার সিনেমাগুলোতে বেশ স্থুল অভিনয় করতেন। সেই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ভীষণ সাহায্য করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। গুণী এই নির্মাতার ‘ঊনিশে এপ্রিল’-এ স্বল্প উপস্থিতি থাকলেও ‘উৎসব’ সিনেমায় এক অন্যরকম প্রসেনজিৎকে দেখতে পায় দর্শকরা।
পরবর্তীতে এই জুটির দেখা মিলেছিল ‘দোসর’ সিনেমায়। অনন্য অভিনয়ের জন্য প্রসেনজিৎ এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ জুড়ি পুরস্কার পান। এছাড়া বিখ্যাত ‘চোখের বালি’, ‘খেলা’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’, ‘নৌকাডুবি’ থেকে ইংরেজি ছবি ‘দ্য লাস্ট লিয়র’তেও এই নির্মাতা – অভিনেতা-নির্মাতা জুটিকে দেখা মিলেছিল।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘স্বপ্নের দিন’ সিনেমাটিও তার ক্যারিয়ারে এনেছিল অন্য মাত্রা। গত দশকে বাণিজ্যিক ভাবে হিটের মধ্যে ‘সূর্য’, ‘পরিবার’, ‘সবুজ সাথী’ অন্যতম। ২০১০ সাল তার ক্যারিয়ারের জন্য অন্যতম উল্লেখযোগ্য বছর। বাণিজ্যিক সিনেমার চিরাচরিত ধারা পেরিয়ে সৃজিত মূখ্যার্জীর ‘অটোগ্রাফ’ ও গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’-এর সাফল্যে নিজেকে তিনি নতুন ঢঙে সাজাতে থাকেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলিয়েছেন।
আর তাই তো তিনি উপহার দিয়েছেন ‘বাইশে শ্রাবন’, ‘চলো পাল্টাই’, ‘প্রাক্তন’, ‘জুলফিকার’, ‘মিশর রহস্য’, ‘ইয়েতি অভিযান’-এর মত সুপারহিট সিনেমা। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ‘জাতিস্মর’ সিনেমার কথা। দু’টি চরিত্রে নিজেকে অনবদ্য ভাবে তুলে ধরেছেন। এছাড়া ‘শঙ্খচিল’, ‘ময়ূরাক্ষী’ তো আছেই। গেলো বছরও বেশ সুবর্ণ সময় কাটিয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বছরের শুরুতেই ‘দৃষ্টিকোণ’-এর মত সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। এরপর পুজোয় এসেছে ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’। যা দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে বেশ জোরেশোরে।
তবে একটা দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বর্ণাঢ্য এই রঙিন ক্যারিয়ারে এখনো সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পাননি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। যেটা বিশাল অপ্রাপ্তিই বটে। আশা করছি অচিরেই এই প্রাপ্তি যোগ হবে। এছাড়া ফিল্মফেয়ার (ইস্ট), বিএফজে পুরস্কার তিনি বহুবার পেয়েছেন। নায়িকাদের সাথে জুটি হিসেবে ঋতুপর্ণার সঙ্গে রেকর্ড গড়েছেন। প্রযোজক হিসেবেও সুনাম রয়েছে তার। এই পর্যন্ত পরিচালনা করেছেন দুটি ছবি। বেশকিছু হিন্দি ছবি করেছেন।
তবে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’র মত সিনেমা। ‘চোখের বালি’ সিনেমায় কাজ করেছেন স্বয়ং ঐশ্বরিয়া রায়ের বিপরীতে। তিনটি যৌথ প্রযোজনা ছাড়াও বাংলাদেশে করেছেন ‘প্রিয়শত্রু’ নামে একটি সিনেমা।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায় ১৯৬২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। তিনি অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়কে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯২ সালে। তিন বছর সংসারের পর ছাড়াছাড়ি হয় তাদের। এরপর ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন অপর্ণা গুহঠাকুরতাকে। সেই বিয়েও ভাঙে ২০০২ সালে। সে বছরই বিয়ে করেন আরেক অভিনেত্রী অর্পিতা পালকে। এবার গিয়ে সংসারটা টিকে যায়। ঠিক ওই সময় থেকেই ক্যারিয়ারের নতুন এক অধ্যায়েও প্রবেশ করেন প্রসেনজিৎ। হয়ত আরো বেশ কিছুদিন তার রাজত্ব দেখা যাবে কলকাতায়। এরপর তিনিও বাবার চরিত্রের জন্য ফিক্সড হয়ে যাবেন মৃত্যু অবদি।