সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘মোহর বা কাবিনের’ গুরুত্ব...

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৬:১৮ পিএম, ১৩ মার্চ ২০১৯ বুধবার

বিবাহ মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নেয়ামত। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত।

ঈমানের পূর্ণতার সহায়ক। চারিত্রিক আত্মরক্ষার অনুপম হাতিয়ার। যুবক-যুবতীর চরিত্র গঠনের অন্যতম উপাদান। আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিবাহ।

ইসলামিক শরিয়ামতে সামর্থ্যবান প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর উভয়ের জন্য বিবাহ ওয়াজিব বা আবশ্যক।

বিবাহ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নারীদের মধ্য হতে পছন্দমতো বিবাহ কর। দুই, তিন, চার, যদি তাদের সকলের প্রতি ইনসাফ করতে পার। অন্যথায় একটাই।’ (সূরা নিসা, আয়াত- ৩)

এবং স্বাভাবিক জীবনেও বিবাহ অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাইতো হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা বিবাহ কর কেননা তা চক্ষুকে অবনত রাখে, লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে।’

বিবাহের জন্য ইসলামি শরিয়াতে কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে, তার ভেতর প্রধান মোহর। উক্ত বিষয়টি নিম্নে পবিত্র কোরআন এবং হাদীসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো- 

(১) মোহরের পরিচয়:

স্ত্রীর লজ্জাস্থান হালাল করার জন্য নির্ধারিত পরিমান টাকা বা কোনো কিছু প্রদান করা। মোহর একজন নারীর অধিকার, কোনো উপহার নয় যে মন চাইলে দিব না হলে দিব না।

(২) মোহর সম্পর্কে কোরআনের আয়াত:

সূরা নিসার ৩নং আয়াতে আল্লাহ সূবাহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নারীদের মোহর সন্তুষ্টে চিত্তে দিয়ে দাও, আর তারা যদি খুশি হয়ে তোমাদের জন্য কোনো অংশ ছেড়ে দেয় তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে খাও,’

এছাড়াও পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার-২৪, সূরা মুমতাহিনার ১০ নাম্বর আয়াতেও মোহর প্রদানের কথা উল্লেখিত হয়েছে।  
 
উল্লেখিত আয়াতের মাধ্যমেই প্রমাণিত হচ্ছে যে বিবাহ শুদ্ধির জন্য মোহর প্রদান আবশ্যক।

(৩) হাদীসের আলোকে মোহর:

মোহর একজন নারীর হক, যদি কোনো ব্যাক্তি মোহর অনাদায়ের ইচ্ছা নিয়ে বিয়ে করে তাহলে সে ব্যাভিচারী হবে। সে বিষয়েই রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যা মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি কোনো মেয়েকে মোহরানা দেওয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু মোহরানা দেওয়ার ইচ্ছে নেই, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ব্যাভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।’

তাই একজন নারীকে বিবাহ করার পর তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্বেই তার হক তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

মোহরের যে কতটা গুরুতপূর্ণ বিষয়, তা বুখারীর হাদীসই প্রমাণ বহন করে।
 
সাহল সাদ বলেন আমি অন্যান্য লোকের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন এক নারী দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমি নিজেকে আপনার জন্য হেবা করলাম, আপনি আমাকে গ্রহণ করুন। কিন্তু রাসূল (সা.) কিছুই বললেন না।

নারীটি এরূপ তিনবার বলল, কিন্তু তিনবারই রাসূল (সা.) চুপ থাকলেন। তখন এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন আপনি যদি গ্রহন না করেন তাহলে এই নারীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিন। রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নিকট কী নারীকে মোহর দেওয়ার মত কিছু আছে? তিনি বললেন, না।

তখন রাসূল (সা.) বললন তোমার বাড়ি থেকে খোঁজ করে একটি লোহার আংটি হলেও নিয়ে আস। কিন্তু তিনি তাও আনতে পারেনি। তখন রাসূল (সা.) বললেন তোমার কী কোরাআনের কিছু মুখস্ত আছে? তখন তিনি বললেন আমার ওই ওই সূরা মুখস্ত আছে। রাসূল (সা.) বললেন, নারীকে ওই সূরাগুলো শিখিয়ে দিও, সেটাই তোমার মোহর।

উপরোক্ত হাদীসটি পানির মত পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে নারীকে মোহর প্রদান করা অত্যাবশ্যক।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে, বর্তমান সমাজ মোহরকে কাবিন বানিয়ে দিয়েছে, আর এর প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই যে, তা তাদের আদায় করতে হবে। কনেপক্ষ ছেলে পক্ষকে কাবিন বেশি করার জন্য চাপ দেয়। তারা ভাবে যে তাহলে মনে হয় তাদের মেয়ের সংসার আর ভাঙ্গবে না। অপরদিকে ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষকে যৌতুক বেশি করার জন্য চাপ দেয়।

বর্তমান সমাজে একজন ছেলে ইসলামিক রীতিনীতি মেনে বিয়ে করতে চাইলে তার জন্যে মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ কোনো পরিবারই তার মেয়েকে কম টাকায় কাবিনে বিয়ে দিতে চায় না এই ভয়ে যে পরে যদি আবার মেয়েকে ছেড়ে দেয়। এর মূল কারণ হচ্ছে আমরা ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে গেছি, অথচ মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) এর বিধানই হচ্ছে নগদ মোহরনায় বিয়ে করা। আমরা যখন ধর্ম থেকে দূরে সরে গেছি তখনই শয়তান এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং সে তার বিধান চালু করে দিয়েছে আর সেটা হচ্ছে যৌতুক।

(৪) মোহরের পরিমাণ:

মোহরের পরিমাণ নিয়ে আলেমদের মাঝে মতের অমিল রয়েছে। সুফিয়ান ছাওরী ( রহ.), শাফিঈ (রহ.), আহমাদ ও ইসহাক ( রহ.) বলেছেন, ‘যে পরিমাণ মোহরে উভয়ে রাজী হবে ততটুকুই মোহর। মালিক ইবনু আনাস (রহ.) বলেছেন সর্বনিম্ন মোহর এক দিনারের এক চতুর্থাংশের কম হতে পারে না। (ইবনু মাজাহ- ১৮৮৭)

আবু আজফা (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন ওমার ইবনুল খত্তাব (রা.) বলেছেন সাবধান! তোমরা নারীদের মোহরানা উচ্ছহারে বৃদ্ধি করো না। কেননা যদি দুনিয়াতে তা সম্মানের বস্তু হতো তবে এ ব্যাপারে নবী (সা.) তোমাদের চেয়ে বেশি উদ্যেগী হতেন। কিন্তু রাসূল (সা.) বার উকিয়ার বেশি পরিমাণ মোহর দিয়ে তার কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন অথবা কোন কন্যাকে করিয়েছেন আমার জানা নেই। অথচ বর্তমান সমাজে মোহর বেশি না করলে বিয়েই ভেঙ্গে যায়।
 
(৫) মোহর নির্ধারণ করা ছাড়াই বিবাহ করে মৃত্যু বরণকারীর করণীয়:

মোহর নির্ধারণ করা ছাড়াই বিবাহ করে মৃত্যুবরণকারীর বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে মাকিল বিন সিনান আল-আশজাঈ বর্ননা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.)-কে এক ব্যাক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, সে এক মহিলাকে বিবাহ করার পর তার সঙ্গে সহবাস ও মোহর ধার্য করার পূর্বেই মারা গেছে। রাবী বলেন আব্দুল্লাহ (রা.) বললেন সেই মহিলা মোহর পাবে, মীরাস পাবে, ইদ্দত ও পালন করতে হবে। মাকিল বিন সিনান আল-আশজাঈ দাঁড়িয়ে বললেন, আপনার ফয়সালা আল্লাহর রাসূলের ফয়সালার অনুযায়ী হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) ও বিরওয়া বিনতু ওয়াশিকের ক্ষেত্রে এই ফয়সালাই দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআন এবং হাদীসের আলোকে এই কথাই বুঝা যাচ্ছে বিবাহ করার জন্য মোহর প্রদান করা আবশ্যক। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকেই তাঁর বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করে ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন মুক্তির লাভ করা ও সমাজের সকল স্তরে তার বিধান প্রতিষ্ঠা করার তাওফিক দিন। আল্লাহুম্মা আমিন।